ঢাকা, শুক্রবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

একজন স্বাবলম্বী নারী- কবি নুরুল সিপার খাঁন

প্রকাশ: ২০২২-০৩-০৯ ০১:১৭:৫৭ || আপডেট: ২০২২-০৩-০৯ ০১:২২:০২

আজকের নারী ঘরে বাইরে। মিছিলে মিটিংয়ে ভ্রমণে অফিসে-আদালতে কোথায় নেই নারী।
নারীর পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে প্রতিটি ক্ষেত্র।
বহিঃবিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের নারীরা ও এগিয়ে চলছে,অর্জন করেছে বহুবিদ সাফল্য আর সাধন করেছে অসাধ্যকে।
বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ আমি প্রতিষ্ঠিত এক স্বাবলম্বী নারী।

আমার বাবা একজন স্কুল মাস্টার দুই ভাই-বোন আমরা।
আমার স্পষ্ট মনে আছে দাদা তখন বেঁচে নেই, আমি সবে ক্লাস সেভেনে পড়ি।
দাদিকে দেখতাম সব সময় ভাইকে একটু বেশি আদর করতো।

আমি ক্লাস সেভেন থেকে যখন এইটে উঠলাম তখন কৃতিত্বের সাথে পাস করলাম।
আমার বাবা তখন আমার প্রতি আরও খেয়াল বাড়িয়ে দিল মাকে বললো দেখো আমার মেয়ে একদিন অনেক বড় হবে মানুষের মত মানুষ হবে।

বাবার কথাটা যেন ভাল চোখে দেখল না আমার দাদী
পাশের ঘর থেকে চিৎকার করে বলে উঠলো -হ্যাঁরে আফজাল তুই দেখি আজকাল মেয়েকে নিয়ে বেশি আদিখ্যেতা শুরু করে দিয়েছিস।

বলি যতই লেখাপড়া শেখাস না কেন শ্বশুরবাড়ি গেলে সেই তো উনুনে লাকড়ি ঠেলে ভাত রান্না করতে হবে। আমার বাবা তো জমিদার ছিলেন কই আমি কি বসে থাকতে পেরেছি আমাকে তো সেই প্রতিদিন সকালে উঠে উনুন জ্বালিয়ে রান্না করতে হবে।
দাদিমার কথাটা শুনে মা বাবা দুজনেই থ হয়ে গিয়েছিলেন।
সেদিন আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি পড়ালেখা শিখে প্রতিষ্ঠিত হবো-ই,উনুনে লাকড়ি ঠেলে আর ভাত রান্না করবো না!
হলোও তাই আজ আমি বিসিএস ক্যাডার মানে নারী ইউ এনও।
সেই প্রতিষ্ঠিত হলাম কেবল দাদিকে হারাবার পর আজ যদি দাদীমা বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো তিনিও খুশি হতেন।

দাদীমা গত হয়েছে বছর কয়েক হল।
বিসিএস পরীক্ষার রেজাল্ট পাওয়ার পর আমি বাড়িতে ফিরে দেখি আমাদের বাড়ির পুরো উঠোন ভরে গেছে মানুষে।
কেউ ফুল দিচ্ছে,কেউ ধন্যি ধন্য করছে। বিসিএস ক্যাডার বলে কথা। পাশের বাড়ির রামিসার মা সম্পর্কে আমার দাদী হতেন তিনিও আজ পায়েস এনে আমার মুখে ঠেলে দিয়ে বললেন দিদিভাই তুই অনেক পাশ দিয়েছিস এবার তোর আলোয় আলোকিত হোক পুরো জগদীশপুর গ্রাম।

দাদীমা কোথায় চোখটা আমার আলোয় ভরে গেল। যে দাদীমা আমার লেখাপড়া নেই সবসময় ভেংচি কাটতে আজ তিনি——-
সত্যি কথা ইতো বলেছেন তিনি।
এখন থেকে আমার একটাই লক্ষ্য থাকবে গ্রামের নারীরা যেন নিরক্ষর না থাকে বিশেষ করে কন্যা শিশু যেন লেখাপড়া করার সুযোগ পায়।

আজ আমি ইউএনও একটি থানার দায়িত্বে আছি। করোনা কালীন সময়ে প্রতিদিন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতাম, দায়িত্ব পালন করতাম, মানুষকে সচেতন করতাম, যারা অন্যায় ভাবে খাদ্য স্টক করত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতাম।

এই আমি এতকিছু পারি কিভাবে মাঝে মধ্যে বলে ফেলতেন আমার স্বামী।
বেচারা সারাদিন খাটাখাটনি করে এসে আমার পেছনে লাগত।

কখন কি খাব কি করব সে যেন অস্থির হয়ে যেত। আমার তিন বছরে কন্যা শিশু লুবাবা কলিংবেল চাপতেই দৌড়ে দরজার সামনেচলে আসে। লুবাবাকে দূর থেকে সান্তনা দিয়ে সোজা চলে যেতাম ওয়াশরুমে।
গতবছর করোনায় হঠাৎ মায়ের মৃত্যু হলো শেষ দেখাটা দেখতে পেলাম না মাকে।

রক্তের সম্পর্কের বিপদের চেয়ে দেশের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য যেন আমার ঢের গুণ বেশি বেড়ে গিয়েছিল তখন।
বাবা যখন ফোন করে বলল তোর মা আর নেই তখন আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলাম মা বলে।

যে মা জন্ম না দিলে এই পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখতে পেতাম না অথচ সেই মায়ের বিয়োগে মায়ের পাশে থাকতে পারলাম না এর থেকে বড় কষ্ট পৃথিবীতে আর কি হতে পারে।

স্বজন হারানোর বেদনা যে কতটা নিদারুণ হতে পারে তা কেবল যে হারায় সেই বুঝে।

আমার দুগণ্ড দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল, বড় অবাধ্য এই অশ্রু ,জানেন তো পৃথিবীতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও এই অশ্রুকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
সে ঝরে পড়ে কারণে-অকারণে দুচোখ বেয়ে। আমার বেলায় ও তার ব্যপ্তয় ঘটেনি।

আমি যেদিন ইউএনও হিসেবে প্রথম জয়েন করেছিলাম সেদিন আমাকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তখন আমাকে প্রশ্ন করেছিলো আমার এই সাফল্যের পিছনে কে ছিলেন।
আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে অকপটে বলেছিলাম –আমার বাবা মা।
মা প্রতিনিয়ত আমাকে সাহস যুগিয়েছে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত হবার।
আর বাবা অর্থের যোগান দিয়েছেন পাশাপাশি নিজের প্রতি আত্ম মনোবল রাখার কৌশল শিখেছেন।

সেদিন মঞ্চে মাকেও ডাকা হয়েছিল ফুলের তোড়া দিয়ে মাকেও বরণ করা হয়েছিল তখন আমার মা ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে উঠেছিলেন।
আমি বুঝতে পেরেছিলাম এ কান্না দুঃখের নয় সুখের কান্না মেয়ের সাফল্যের কান্না, প্রাপ্তির কান্না।

নারী দিবস এলে আমি কেমন আনমননে হয়ে যায় ভীষণ মনে পড়ে যায় মায়ের সাথে কাটানো পুরনো স্মৃতি।
স্বামী-সন্তান সাফল্য সবকিছুই যেন আমার পূর্ণতা করে দিয়েছে তবুও কোন এক দিকে যেন বিরাট অপূর্ণতার আস্কারা দিয়ে যাচ্ছে,হয়তোবা মায়ের শূন্যতা।

এভাবে নারীরা জেগে উঠুক বাংলার প্রতিটি ঘর থেকে আগুনের পরশমনি হয়ে ,কারো উপর নির্ভরশীল না থেকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে চলার ক্ষমতা অর্জন করুক নারী ।
সেই প্রত্যাশায়

সিএসবি-টুয়েন্টিফোর ডেস্ক-৯/৩'(থ)