ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

আদৌ কোনো গুরুত্ব নেই হরতালের !

প্রকাশ: ২০১৪-১১-০৪ ১৬:৪৫:৪৬ || আপডেট: ২০১৪-১১-০৪ ১৬:৪৫:৪৬

untitled-3_147018
মিল্টন বিশ্বাস
গত ২৯ অক্টোবর কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী নিজামীর ফাঁসির রায় ঘোষিত হওয়ার পর তিন দিনের হরতাল, মীর কাসেমের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আরো এক দিন এবং আপিল বিভাগে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকায় আরো এক দিন হরতালের মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে জঙ্গিবাদের সমর্থক দল জামায়াতে ইসলামী। ২ থেকে ৬ নভেম্বর পুরো ছয় কার্যদিবসের এক দিন আবার আশুরার ছুটি ছিল। এ হিসাবে সপ্তাহের পাঁচটি কার্যদিবস বিঘ্নিত হয়েছে কেবল যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে। অথচ এসব হরতালের আদৌ কোনো গুরুত্ব নেই। কারণ হরতাল ডেকে ঘরে বসে থাকে জামায়াত-শিবির ও তাদের সমর্থকরা। অন্যদিকে নাকাল হতে হয় সাধারণ মানুষকে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় অর্থনীতি। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার একাধিক গবেষণা অনুযায়ী, এক দিনের হরতালেই ক্ষতি হয় অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা। আর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে পোশাকশিল্প, ক্ষুদ্র উদ্যোগ ও পরিবহন। একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ১৯৭৫ থেকে গত বছর পর্যন্ত হরতালের কারণ বিশ্লেষণ করে বলেছে, এ পর্যন্ত যত হরতাল হয়েছে, তার প্রায় ৯৫ শতাংশই ডাকা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। মাত্র পাঁচ শতাংশ হরতাল হয়েছে অর্থনৈতিক কারণ কিংবা জনস্বার্থে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল গত বছরের আগস্টে এক প্রতিবেদনে বলেছে, হরতাল বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট সমস্যা। এ নিয়ে অনেক দিন ধরেই ধুঁকছে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালের এপ্রিলে পোশাক কারখানা ধসের ঘটনায় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া বাংলাদেশের সামনে লাগাতার হরতাল ডাকার সংস্কৃতি নতুন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের দেওয়া হিসাবে, হরতালের কারণে গত বছর প্রায় ৫৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকার (৭০০ কোটি ডলার) ক্ষতি হয়েছে। প্রতিদিনের ক্ষতি প্রায় এক হাজার ৫৪০ কোটি টাকা (২০ কোটি ডলার)।

তবে এ কথা সত্য, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জামায়াত-শিবিরের হরতাল ও রাজনৈতিক সহিংসতা আমাদের জীবনে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করছে। প্রতিবিধান চেয়ে বর্তমান সংসদ হরতাল বন্ধে কার্যকর উপায় অন্বেষণ করেছে। মিডিয়ায় বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তবু কোনো পথ এখনো জনগণের সামনে জোরালো বিকল্প হিসেবে তুলে ধরা যায়নি; বরং আশঙ্কা আর আতঙ্কে দিন কাটাতে হচ্ছে প্রয়োজনে রাস্তায় বের হওয়া মানুষকে, বিপন্ন হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতা, নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়া নিয়ে তারাও বিচলিত রয়েছে। বছরের শেষে একাডেমিক বর্ষ সমাপ্তির সময় রাজনৈতিক সহিংসতা শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে। ফলে তারা বিপন্নতা বোধ করবে- এটাই স্বাভাবিক। তাদের সঙ্গে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা আরো বেশি মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। আমাদের অর্থনীতিকে শিক্ষামুখী বলা হলে সেই শিক্ষার সড়কটি পরিষ্কার রাখা জরুরি। কিন্তু হরহামেশাই সেই রাস্তা কণ্টকাকীর্ণ হয়ে পড়ে। এ জন্য কেবল পোশাকশিল্প কিংবা ব্যবসায়ীদের ক্ষতি নয়, তিন কোটি শিক্ষার্থীর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হতে না পারার ব্যর্থতা রাজনীতিবিদদের কাঁধে এসে পড়ে স্বাভাবিকভাবেই। উত্তরণের উপায় কী? সাধারণ জনতাকে জিজ্ঞেস করলে তারা একবাক্যে হরতালের ক্ষতি সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ দিতে সক্ষম হবে। যেমন একটি পত্রিকায় প্রকাশিত পাঠকদের মধ্যে দুটি প্রতিক্রিয়া ছিল এ রকম- ‘আমরা পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছি, গত দুই দশকে গণতান্ত্রিক শাসনামলে যত হরতাল হয়েছে তার এক-দশমাংশও হয়নি সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়। সুতরাং গণতান্ত্রিক সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এ বিষয়ে মনোযোগী হওয়া অপরিহার্য।’ ‘এ হরতাল কেন? একবিংশ শতকে এই ভোঁতা অস্ত্র আর কত দিন এই জাতির ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। হরতালের যৌক্তিকতা যতই থাকুক না কেন; বর্তমান যুগে সাধারণ মানুষ কখনো হরতাল সমর্থন করে না এবং পছন্দও করে না। এ হরতালে মানুষগুলো জীবন দিচ্ছে কিংবা যারা পঙ্গু হচ্ছে তাদের দায় কার? অর্থনীতির চরম ক্ষতি তো হচ্ছেই, অহরহ অগণিত সাধারণ মানুষও বলি হচ্ছে। অনেকে বলেন, হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার। ধিক এই অধিকারকে। যে অধিকার দেশ, জাতি ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর, সে কারণেই এ ধরনের কর্মসূচি বন্ধ করা উচিত। বর্তমানের হরতালগুলো সরকারের শুভ কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া; কিন্তু তা জনগণের ওপর বর্তাচ্ছে। সরকারের উচিত দেশ ও জাতির স্বার্থে, জনগণের অধিকার রক্ষায় জামায়াত-বিএনপির হরতাল আইন করে বন্ধ করা।’ দুজন সাধারণ নাগরিকের এসব মন্তব্য আমাদের বর্তমান প্রজন্মের মনের কথাও বটে। কিন্তু কেবল আইন করে হরতাল বন্ধ করার প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকল্প খুঁজতে হবে। ক্ষমতাসীন আর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোর সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের পটভূমি। হরতালের কারণে ব্যবসায়ীদের লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ গুনতে হচ্ছে; সাধারণ মানুষ ও খেটে খাওয়া দিনমজুরের আয়ের পথে বাধা এটি। সব মিলিয়ে সরকারের প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও বিশৃঙ্খলায় দেশ ও জাতি নিমজ্জিত হচ্ছে। সুতরাং আমরা আশা করছি, দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দ হরতালের বিকল্প চালু করতে সক্ষম হবেন।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা থাকতে হবে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধও। আবার নিজের দলের মধ্যে কোন্দলের সুযোগে তৃতীয় পক্ষ জায়গা দখল করে ক্ষমতা প্রদর্শন করতে না পারে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য আমাদের রাজনীতিতে একটা কারণ তৈরির চেষ্টা ধূলিসাৎ করা দরকার। যদিও এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনও সক্রিয়। নিজামী ও মীর কাসেমের ফাঁসির রায়ের পর সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া আমরা পেলাম। নির্লজ্জভাবে তারা একাত্তরের অপরাধীদের সমর্থন জানিয়েছে। এ জন্য আমাদের বৃহত্তর জনগণের কথা ভাবতে হবে। জনগণের পক্ষের যে রাজনৈতিক শক্তি, যেটা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিকশিত হওয়ার কথা ছিল, তার পক্ষে কাজ করতে হবে বর্তমান সরকারকে। এটাই আমাদের রাজনীতির প্রধান সক্ষমতার পরিচয় হবে। আমাদের জনগণ হরতাল ও নাশকতার মতো পরিস্থিতি মেনে নিচ্ছে না। তারা খুব বিক্ষুব্ধ। কিন্তু তাদের কোনো মুখপাত্র নেই। তাদের সংগঠিত কোনো শক্তি নেই। তবু তারা বিছিন্নভাবে হরতালের বিপক্ষে বলছে। বাম শক্তিগুলোও একটা বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জনগণ কিন্তু একটা সামাজিক পরিবর্তনের কথা ভেবেছিল। সেই পরিবর্তন সম্পন্ন করার দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর। হরতালের কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়, এ দেশ যে বিনিয়োগের একটি আস্থাভাজন স্থান, সেই আস্থার জায়গাটি নষ্ট হয়, রপ্তানির নিরাপদ উৎস হিসেবে বাংলাদেশ আর বিবেচিত হয় না। তা ছাড়া বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা যেসব সতর্কতামূলক নির্দেশ প্রচার করে, তাতেও বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশ্বায়নের এ যুগে একবার আস্থার সম্পর্ক নষ্ট হলে তা সহজে ঠিক করা যায় না। অন্যদিকে হরতাল মানেই জনজীবনকে বিপর্যস্ত এবং মানুষের স্বাধীনতায় নগ্ন হস্তক্ষেপ করা। হরতালে বোমা মেরে মানুষ খুন, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে যাত্রী বা চালককে খুন করে এমন ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়, যা দেশ-বিদেশের সবাইকে আতঙ্কিত করে তোলে। হরতালে রাষ্ট্র ও জনগণের উপকার কিংবা উন্নতি হয়েছে- এমন নজির বিশ্বের কোথাও দেখা যায় না। সেই ক্ষতির হিসাব আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে হরতালমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। তবেই আমাদের অসহায়ত্ব দূর করা সম্ভব হবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]