ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

কীভাবে বড় হচ্ছে আদরের সন্তান

প্রকাশ: ২০১৪-১০-২২ ১৪:৫৪:৫৩ || আপডেট: ২০১৪-১০-২২ ১৪:৫৪:৫৩

resize_1366767514
টিভি চ্যানেল খুললেই খুন, ধর্ষণ আর লুটপাটের খবর। পত্রিকার পাতায়ও তাই। তার মানে রাষ্ট্র তার নাগরিকের কাছে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বার্তা দিচ্ছে। সমাজ তাকে একটি কলুষিত পরিবেশের বার্তা দিচ্ছে। শেষ আশ্রয় তার পরিবারেও নেই সুখ আর স্বপ্নের সুবাতাস। কোথায় যাবে তারা? কার কাছে? এই ভাবনা হোক এখন আপনার, আমার, আমাদের সবার।

এস এম মুকুল::
গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি কি আমরা? সামাজিক অবক্ষয় কোথায় নিয়ে ঠেকাবে আমাদের? সমাজ জীবনে কেন এত অস্থিরতা? পারিবারিক জীবনে কেন নিষ্ঠুরতার প্রভাব? কোনদিক যাচ্ছে সমাজ? খুন, হত্যা, আত্মহত্যা, ডিভোর্স, প্রেম-প্রতারণা_ আসলে কি ঘটছে, কেন ঘটছে? এসবের মাঝে ‘কীভাবে বেড়ে উঠছে আমাদের আদরে সন্তান?’_ এই প্রশ্নটি আমরা কি নিজেকে করছি?

সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধ বিশেষজ্ঞ, মনোচিকিৎসকরা বলছেন, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের দিকে এখনই নজর দিতে হবে। সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। আমার আজকের লেখার বিষয় আসলে সামাজিক অবক্ষয়গুলো কী কী। অথবা কীভাবে ঘটছে এই অবক্ষয়।

পবিত্র ধর্মগ্রন্থে সন্তানকে মানব জীবনের পরীক্ষা এবং আমানত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ পরীক্ষা হলো সন্তানের জন্য নিজের আত্মশুদ্ধি আর আমানত হলো সন্তানকে যথাযথ ধর্মীয় অনুশাসনে পরিচর্যা করা। কিন্তু আমরা কি তা করছি?

এই নির্মোহ সত্য উপলব্ধির সময় এসেছে আজ। সময় নেই সময় নেই বলে যে পাগলা ঘোড়ার পেছনে ছুটছি আমরা সেই নির্মম সময়ের জালেই ধরা দিতে হয়েছে আমাদেরকে। কোথায় ভুলগুলো হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে। কীভাবে বড় হচ্ছে আমাদের আদরে সন্তান? আমরা কি ভাবছি এসব নিয়ে।

অর্থ উপার্জন, বিত্ত-বৈভব আর রাতারাতি আর্থিক সমৃদ্ধির খোলস পাল্টানো অনিশ্চিত-অন্ধকার গোলক চক্রে ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছি আমরা। বিত্ত অর্জনের অসম প্রতিযোগিতায় জীবনকে সাজাতে গিয়ে জীবনে বয়ে আনছি বেদনা-বিধূর দুঃসময়ের হাতছানি। বাবা-মা নিজেদের বিবেকবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে বোধহীন মানুষের মতো অর্থ আর প্রতিপত্তির পেছনে ছুটছি। আমরা কি ভেবে দেখেছি এই টাকা কোন কাজে লাগবে? আদরের সন্তান যদি মানুষের মতো মানুষ না হয়_ কি হবে এই টাকা দিয়ে? বরং বৈধ-অবৈধ পথে এমন টাকার খেসারত হচ্ছে_ অহঙ্কারী ও উচ্ছৃঙ্খল সন্তান, অথবা নেশাগ্রস্ত ও অসামাজিক সন্তান। মনে রাখতে হবে, টাকা দিয়ে যদি সন্তানদের মেধাবী আর সভ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যেত তাহলে পৃথিবীতে পুঁজিবাদী আর বর্জোয়াদের ছেলেমেয়েরাই হয়ে উঠতে সভ্যতার আলোকবর্তিকা। কিন্তু বাস্তবতা কি বলছে? ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে_ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ-ব্যারিস্টার, সাংস্কৃতিককর্মী, সৃজনশীল উদ্যোক্তা_ এসব কিছুর আতুর ঘর গ্রাম বাংলার কৃষক পরিবার আর সমাজ সচেতন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। গ্রামের কৃষক পরিবার থেকে আসা ছেলেমেয়েরা ঢাকার আলোর ঝলকানিতে পড়েও তো পিতা-মাতার বিশ্বাসকে ভঙ্গ করেনি।

সমাজে কোন আদর্শিক মডেল খুঁজে পাচ্ছে সন্তানরা। না আদর্শবান হতে পারছি বাবা-মায়েরা, না পারছে আমাদের শিক্ষক সমাজ অথবা রাজনীতিবিদরা। সন্তানের কাছে সবার আগে আদর্শের মডেল হবেন বাবা-মা। তারপর শিক্ষক। কিন্তু সেই অর্থে সব বাবা-মা তা পারছে না। শিক্ষকরা নানান অপকর্মে জড়িয়ে নিজেরাই হয়ে পড়েছেন আদর্শহীন। একজন শিক্ষক যদি অপকৌশলে শতাধিক শিক্ষার্থীকে ক্রমাগতভাবে ধর্ষণ করে; তার কাছে কি পাবে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা? রাজনীতিতে তো আদর্শের লেশমাত্রও নেই। তাহলে কোথায় যাবে ওরা? ভালো কোনো খবর নেই তাদের সামনে। পত্রিকার পাতা উল্টালে, টিভি চ্যানেলের খবর দেখলে খুন-খারাপি, ধর্ষণ আর লুটতরাজের খবরগুলো যেভাবে ফোকাস করা হয় ভালো উদ্যোগ ও সফলতার খবরগুলোকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় না। তাহলে তারা ভালো কাজে উৎসাহ পাবে কিভাবে? স্বপ্ন দেখবে কিভাবে?

আমাদের দেশে শিক্ষায়-বিনোদনমূলক শিশু-কিশোরদের উপযোগী অনুষ্ঠানের স্বল্পতা লক্ষণীয়। প্রচারিত বিজ্ঞাপনে শিক্ষণীয় কিছু নেই। আকাশ সংস্কৃতির অপছায়া গ্রাস করছে কোমলমতি হৃদয়গুলোকে। ইন্ডিয়ার চ্যানেলগুলোতে দুই ধারার কূটকৌশল লক্ষণীয়। প্রথমটি হলো_ এরা অনুষ্ঠান আয়োজনে উদ্ভট চরিত্রায়ন করছে। পারিবারিক কহলবাদের কৌশল শেখাচ্ছে। নারী চরিত্রকে শয়তানের প্রতিচ্ছায়া হিসেবে উপস্থাপন করছে। ঘরোয়া দৃশ্যতে উদ্ভট সাজগোজ বিকৃত রুচি ও মানসিকতার সৃষ্টি করছে। এভাবে এসব চ্যানেলগুলো বাঙালির চিরায়ত পারিবারিক সম্পর্কের শেকড় নষ্ট করে দিতে চেষ্টা করছে। অপসংস্কৃতি আর বেলাল্লাপনার মাধ্যমে তারা আমাদের সন্তানদের জীবন থেকে সুন্দরতম স্বপ্নগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। দ্বিতীয়টি হলো_ তাদের পোশাকের বাজার সৃষ্টি করছে আমাদের দেশে। চটকদার পোশাকের আচানক ঢংঢাং দেখে আমাদের সন্তানরা এমনকি তাদের মায়েরা পর্যন্ত কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে দেশি পোশাকের মাধুর্যময়তা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক হানিফ সঙ্কেত যথার্থই বলেছেন_ ‘ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে থেকে মাংস কেড়ে নেয়া সম্ভব, কিন্তু হিন্দি বা ইন্ডিয়ান বাংলা সিরিয়াল দেখারত অবস্থায় বাঙালি নারীর কাছ থেকে রিমোর্ট কন্ট্রোল কেড়ে নেয়া সম্ভব নয়।’ বাস্তবতা আসলে তাই। ছোট থেকে বড় পরিবারের সবাই ঝেঁকে বসেছে এসব অপসংস্কৃতির গড্ডালিকায়। ভারতে বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল দেখার সুযোগ নেই। আমাদের সরকার কেন পারে না এইসব চ্যানেল প্রচার বন্ধ করতে? এক খবরে জানা গেছে_ খোদ ভারতের জনগণ এসব অনুষ্ঠানের বিপক্ষে তাদের মতামত দিতে শুরু করেছে। আর আমরা তা গ্রহণ করছি_ কোন যুক্তিতে?

অপরদিকে সন্তানদের আমরা কর্তব্য পরায়ণ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছি। সন্তান যখন যা চায় তাকে তা-ই দিয়ে তার চাহিদার মাত্রাকে আকাশচুম্বী করছি। দরকার-অদরকার, সামর্থ্য-সীমাবদ্ধতার কথা তাদের জানানো হচ্ছে না। এ কারণে তারা সমস্যা ও অপারগতার বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছে না। তাদেরকে শেখানো হচ্ছে না বাবা-মাকে কাজে সাহায্য করা, পারিবারিক কাজে অংশগ্রহণ করা, আচার অনুষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করা তারও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সাধারণত বলা হয়ে থাকে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সে প্রতিটি ছেলেমেয়ে অসম্ভব ঝুঁকিতে থাকে। এই সময়ে তাদেরকে সুন্দর পথ দেখানোর দায়িত্ব বাবা-মায়ের। আর বাবা-মা যদি সন্তানের দিকে খেয়াল না করে বৈধ-অবৈধ টাকার ভেলায় ভেসে বেড়ান, তাহলে ঐশীদের আর দোষ কি?

আমাদের দেশের শিক্ষায় নির্মল বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। শিক্ষা কারিকুলাম গৎবাঁধা নিয়মের ছকে তৈরি। শিক্ষা কারিকুলামে সাফল্য-সম্ভাবনা, সাহসী, সৎ, মেধাবী, কীর্তিমান সমকালীন চরিত্রগুলোকে রূপায়ন করা হচ্ছে না। শুধু গাদাগাদা বই পড়ানো হচ্ছে। শিক্ষায় সহপাঠ্যক্রমের গুরুত্ব নেই। প্রাকৃতিক শিক্ষা ও পেশার বুনিয়াদি শিক্ষা নেই। যেমন_ কৃষকের জীবন সংগ্রাম, তাঁতি কি করে পোশাক তৈরি করে, চিকিৎসক কিভাবে মানবসেবা করে প্রভৃতি বাস্তবভিত্তিক জীবনচিত্র শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরা দরকার। অসম প্রতিযোগিতার হাত থেকে কোমলপ্রাণ সন্তানদের বাঁচাতে হবে। যেমন_ গোল্ডেন জিপিএ পেতেই হবে। নাচটা, গানটা শিখতেই হবে। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেই হবে। এই অকারণ অসম প্রতিযোগিতা আমাদের সন্তানদের বোধহীন নাগরিক হিসেবে বড় করে তোলছে। আমরা বুঝতে চাইছি না আসলে তাকে দিয়ে কি হবে? তাকে দিয়ে কি করানো উচিত? সে কতটুকু মেধা যোগ্যতা রাখে? তার বয়সভেদে সহনীয় ক্ষমতা আর কত হতে পারে? উন্নত বিশ্বে শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো যে_ প্রাথমিক শিক্ষাই তার বুনিয়াদি চূড়ান্ত শিক্ষা দেয়। এ পর্যায় থেকেই নির্ধারিত হয়ে যায় যে_ সে কি ডাক্তার হবে, নাকি শিক্ষক, না অ্যাকাউন্ট্যান্ট। আর আমাদের দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আমার মতো লেখকও হয়! এজন্য প্রথমত শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। আরো বিনোদনমূলক, জ্ঞানানুসন্ধানী, মননশীল কারিকুলাম তৈরি করতে হবে। আর দয়া করে বাবা মায়েরা নিজেদের অযাচিত চাওয়া সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেবেন না। তার যোগ্যতার নিরিখে তাকে বড় হতে দিন। আর যাই হোক না কেন সে অন্তত একজন ভালো মানুষ হতে শিখুক। আমাদেরও ভেবে দেখা উচিত, যে সন্তানকে সেরা ফলাফল করার জন্য দিনরাত চাপ দিচ্ছি_ সেই আমি ছাত্রজীবনে কেমন ফলাফল করতাম?

সমাজে বই পাঠের অভ্যাস কমে যাচ্ছে। বইয়ের জায়গায় এসেছে অনলাইনের তাবৎ দুনিয়া। যেখানে আছে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ইমেইল, মোবাইল-এসএমএস ইত্যাদি। গেমস আর চ্যাটিং আমাদের অগোচরে সন্তানদেরকে চিটিংবাজ হিসেবে তৈরি করছে। বই পঠনের অভ্যাস বাড়াতে হবে। গড়ে তোলা দরকার পারিবারিক পাঠাগার। সন্তানদের পাঠাগারে পাঠানো উচিত। বিশেষ বিশেষ দিবসে, সন্তানের সাফল্যে বাবা-মাকে বই উপহার দিতে দেখা যায় না। স্কুলগুলোতে বইপড়াভিত্তিক প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে। সামাজিক অনুষ্ঠানে আজকাল বই উপহার দেয়ার প্রচলন প্রায় উঠেই গেছে। এক সময় বই পড়া, বইয়ের বিষয় নিয়ে আলোচনা, বই আদান-প্রদানের মাধ্যমে সৃজনশীলতা চর্চার সামাজিক রেওয়াজ ছিল। সেই রেওয়াজকে আবারো ফিরিয়ে আনতে হবে।
মনে রাখতে হবে সমাজে নিষ্ঠুরতার জন্ম শুধুমাত্র দুয়েকটি কারণে হয় না। যদি সন্তান মাদকাসক্ত হয়_ তাহলে এই আসক্তির পেছনের কারণগুলোই হলো সামষ্টিকভাবে সামাজিক অবক্ষয়। একদিকে আমাদের সন্তানরা প্রকৃত মূল্যবোধের শিক্ষা পাচ্ছে না। আরেকদিকে পরিবারগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। যেখানে অনেকের মাঝেও নিজেকে একাকী মনে হয়। অপরদিকে দেশের রাজনীতি আমাদের আশাবাদী করতে পারছে না।
টিভি চ্যানেল খুললেই খুন, ধর্ষণ আর লুটপাটের খবর। পত্রিকার পাতায়ও তাই। তার মানে রাষ্ট্র তার নাগরিকের কাছে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বার্তা দিচ্ছে। সমাজ তাকে একটি কলুষিত পরিবেশের বার্তা দিচ্ছে। শেষ আশ্রয় তার পরিবারেও নেই সুখ আর স্বপ্নের সুবাতাস। কোথায় যাবে তারা? কার কাছে? এই ভাবনা হোক এখন আপনার, আমার, আমাদের সবার।

এস এম মুকুল: উন্নয়ন গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
[email protected]