ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

চলে গেলেন ইতিহাসের এক নায়ক

প্রকাশ: ২০১৪-১০-১৪ ১৩:৫৬:৪৭ || আপডেট: ২০১৪-১০-১৪ ১৩:৫৬:৪৭

2_36424
হায়দার আকবর খান রনো:
বাঙালি জাতির ইতিহাসে আবদুল মতিন ছিলেন এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। সারা জীবন তিনি সংগ্রাম করেছেন ভাষার জন্য, জাতি হিসেবে বাঙালির অধিকারের জন্য এবং মেহনতি মানুষের স্বার্থে সমাজতন্ত্রের জন্য। আমি শ্রদ্ধা জানাই এ দেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির অন্যতম পুরোধা আবদুল মতিনকে। আমি শ্রদ্ধা জানাই মেহনতি মানুষের সংগ্রামের অগ্রপথিক, কমিউনিস্ট আবদুল মতিনকে। আমি শ্রদ্ধা জানাই একজন সাহসী পুরুষ, নির্লোভ ব্যক্তি এবং অতি উঁচুমাপের মানুষ আবদুল মতিনকে। একই সঙ্গে তার দুই পরিচয়। ভাষামতিন। কমরেড আবদুল মতিন।

মতিন ভাইয়ের নাম আমি ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি। বিশেষ করে আমার বাবার কাছ থেকে। ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে যে সমাবর্তন সভা অনুষ্ঠিত হয় সেখানে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন। ঘটনাক্রমে সেই হলে আমার বাবাও উপস্থিত ছিলেন। বাবার কাছ থেকে শোনা কাহিনীটি এখন সবারই জানা। জিন্নাহ ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষায় বলেছিলেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। অথচ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ছিল বাংলা, যাকে জিন্নাহ স্বৈরাচারী মানসিকতা নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছিলেন। সে সময়ে হলের মধ্যে যে তরুণ ছাত্রটি ‘নো নো’ বলে চিৎকার করেছিলেন তিনিই হলেন আবদুল মতিন। চিরবিদ্রোহী, চিরপ্রতিবাদী আবদুল মতিন। মতিন ভাইয়ের সঙ্গে অন্য অনেক ছাত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে জিন্নার মুখের ওপর ‘নো’ বলে চিৎকার করেছিলেন। সেদিনের পরিস্থিতিতে জিন্নার মুখের ওপর নো বলাটা বিরাট সাহসের ব্যাপার ছিল। আবদুল মতিনের ভেতর সেই সাহসের কমতি কোনো দিন দেখা যায়নি।

১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল তার তাৎপর্য অপরিসীম। প্রতিক্রিয়াশীল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল। আমাদের বলা হয়েছিল, আমরা বাঙালি নই, মুসলমান। তখন অভিজাত মুসলমানরা ঘরে উর্দু বলতেন। সেটাকে তারা সম্ভ্রান্তের চিহ্ন বলে বিবেচনা করতেন।

এরাই ছিলেন মুসলিম লীগের কর্মকর্তা, যদিও সব শ্রেণির মুসলিম জনগণ পাকিস্তান আন্দোলনের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল। আমাদের দেশের বড় বড় নেতা শেরেবাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবাই পাকিস্তানের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। এটা ভাবতে অবাক লাগে যে, যারা একদিন পাকিস্তানের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন তাদেরই সন্তানরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। এই যে বিরাট পরিবর্তন তার সূচনা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।

ভাষা আন্দোলনই অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনার জন্ম দিয়েছিল। ঘোর সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের জন্মের এক বছরের মধ্যেই এই অসাম্প্রদায়িক ভাষাভিত্তিক জাতীয় চেতনার উন্মেষ মোটেই ছোট ব্যাপার ছিল না। সেদিন একঝাঁক তরুণ নতুন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত হয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছিলেন, যা পাকিস্তানের ভিত্তি দ্বিজাতিতত্ত্বকেই কার্যত প্রত্যাখ্যান করে। এই তরুণদের অধিকাংশই পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেছিলেন।

‘৪৮-এর পর একপর্যায়ে আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু সেই সময়ে একজন তরুণ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রচার ও সংগঠন চালিয়ে যাচ্ছিলেন নিরলসভাবে। তখনই তিনি ভাষামতিন নামটি অর্জন করেন। ভাষা আন্দোলন এবং আবদুল মতিন যেন একাকার হয়ে গেছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ভাষামতিন নামে অধিক পরিচিত ছিলেন।

ভাষা আন্দোলনে আরও অনেকের অবদান আছে। বড় মাপের অবদান রেখেছেন মোহাম্মদ তোয়াহা (পরবর্তীতে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নেতায় পরিণত হয়েছিলেন), অলি আহাদ (পরবর্তীতে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ’র শীর্ষস্থানীয় নেতা হয়েছিলেন, আরও পরে তিনি ন্যাপ পরিত্যাগ করেন), মোহাম্মদ সুলতান (পরবর্তীতে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন), গাজীউল হক (তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন, ন্যাপেরও নেতা ছিলেন, যদিও পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন)। এ কথাও সত্য, ভাষা আন্দোলন পেছন থেকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছিল তদানীন্তন আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টি।

‘৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকায় সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের ওই দিনটি পালন উপলক্ষে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবাধীন ছাত্র ফেডারেশন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না’ (সেই সময় বাংলাবিদ্বেষী সরকারের তরফ থেকে আরবি বা রোমান হরফে বাংলা লেখার একটা উদ্যোগ ছিল) ইত্যাদি স্লোগান দিতে দিতে পরিষদ ভবনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। পুলিশ সেই মিছিলে লাঠিচার্জ করে। ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রভাষা দিবসের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আয়োজিত ছাত্রদের এক প্রতিবাদ সমাবেশে আন্দোলন সংগঠিত এবং কার্যকর পথে পরিচালিত করতে আবদুল মতিন একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। উপস্থিত সাধারণ ছাত্রদের সিদ্ধান্তে আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আন্দোলনের কর্মসূচি পালনের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা সংগ্রহের জন্য জনসাধারণের কাছে অর্থ সংগ্রহের আবেদন জানানো হয়। সেই উদ্দেশ্যে ১৯৫১ সালের ৫ এপ্রিল পতাকা দিবস পালন করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র-ছাত্রী সর্বাত্দক সহযোগিতা প্রদান করেন এবং আশাতীত অর্থ সংগৃহীত হয়েছিল।

১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্র নেতৃবৃন্দের এক সভা আহ্বান করেন। ওই সভায় কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। আবদুল মতিন পরিষদের অন্যতম সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুর্ক্ত হন। পাশাপাশি দুটি কমিটি কাজ করছিল। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়কও ছিলেন আবদুল মতিন। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহরের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছাত্রদের এক সমাবেশ আহ্বান করেন। ওই সমাবেশে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদাদানের ঘোষণাসহ ২১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী পুনরায় সভা, মিছিলসহ নানা ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এ কর্মসূচি প্রতিহত করতে সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। আবদুল মতিনের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-কর্মীরা ১৪৪ ধারা ভেঙে তাদের কর্মসূচি পালনের দৃঢ়প্রত্যয় ঘোষণা করেন। সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিষয়ে আলোচনার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিসহ ছাত্র নেতারা শহরের নবাবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যালয়ে এক সভায় মিলিত হন। মওলানা ভাসানী তখন ঢাকার বাইরে গ্রামে ছিলেন। তাই সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন মুসলিম লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসিম। আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন এবং নানা যুক্তি হাজির করেন। শেষ পর্যন্ত পাল্টাপাল্টি তর্কবিতর্কের পর সভায় ভোটগ্রহণ করা হয়। উপস্থিত ১৫ জনের মধ্যে ১১ জন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে এবং আবদুল মতিন, অলি আহাদসহ চারজন ভঙ্গের পক্ষে ভোট দেন।

২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জমায়েত হন। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের সমাবেশে দুই পক্ষই তাদের যুক্তি তুলে ধরে বক্তব্য রাখে। আবদুল মতিন যেভাবে জোরালো যুক্তিসহকারে উদ্দীপনাময় বক্তব্য উপস্থাপন করেন তাতে ছাত্ররা উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষেই রায় দেন এবং স্লোগানসহ মিছিল শুরু করেন। মিছিলে একপর্যায়ে পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন, আবদুল জব্বারসহ কয়েকজন শহীদ হন এবং অনেকেই আহত হন। একই সঙ্গে চলে গ্রেফতারের হিড়িক। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি আবদুল মতিন আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে শহীদদের গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। যে কোনো আন্দোলনের মতো এই আন্দোলনেও দুটি ধারা ছিল। সংগ্রামী ও আপসমুখী। আবদুল মতিন সংগ্রামী ধারাকেই প্রতিনিধিত্ব করতেন। অন্যদিকে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির অধিকাংশ আপসমুখী ও সংগ্রামবিমুখ ছিলেন। তারা এই কর্মসূচির বিরোধিতা করেন। কিন্তু দেখা গেল সাধারণ মানুষ এই কর্মসূচিতে হাজারে হাজারে এসে জমায়েত হন। এমনকি সচিবালয়ের সাধারণ কর্মচারীরাও অফিস ফেলে ওই কর্মসূচিতে যোগ দেন। সেদিনও গুলি হয়েছিল। শফিউর রহমান, আবদুস সালাম, আবদুল আউয়াল (রিকশাচালক) এবং অহিউল্লাহ (কিশোর)সহ আরও অনেকে শহীদ হন। মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে মানুষ অভ্যুত্থান সৃষ্টি করল। পাকিস্তানের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম গণঅভ্যুত্থান। ২১ ফেব্রুয়ারি হয়ে রইল আমাদের ইতিহাসের একটি মাইলফলক। পাকিস্তান সৃষ্টির পর রাজনীতিতে মোড় ঘুরাল অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতির দিকে। নতুন ইতিহাস রচিত হলো যার একজন নায়ক ছিলেন কমরেড আবদুল মতিন। মুসলিম লীগ সরকার শত শত ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করল। মওলানা ভাসানী, আবদুল মতিন, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহাসহ ১০ জনের নামে হুলিয়া জারি হয়। হুলিয়া মাথায় নিয়ে আবদুল মতিন ছাত্রদের সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত থাকেন। একপর্যায়ে তিনি গ্রেফতার হন। এটা ছিল তার দ্বিতীয় কারাবরণ। এর আগে ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় গ্রেফতার হয়েছিলেন। এবার টানা দুই বছর কারাজীবন। জেলখানায় তিনি কমিউনিস্টদের সংস্পর্শে আসেন এবং মার্কসবাদে দীক্ষা গ্রহণ করেন। পরে তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভ করেন।

১৯৫৩ সালে কারামুক্তির পর তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে রংপুরের ফুলছড়ি ঘাটে কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই গঠিত হয় কৃষক সমিতি। চলি্লশের দশকের ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন, নানকার বিদ্রোহ, নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ ইত্যাদির পর বেশ কয়েক বছর কৃষক আন্দোলন ছিল না বললেই চলে। সেই অর্থে মওলানা ভাসানীর কৃষক সমিতি হলো পাকিস্তান আমলের প্রথম কৃষক সংগঠন। কৃষক সমিতির সভাপতি হয়েছিলেন মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক হাতেম আলী খান, যুগ্ম-সম্পাদক আবদুল মতিন। একজন কমিউনিস্ট হিসেবে আবদুল মতিন কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের সময় তার নামে হুলিয়া জারি হয়। তিনি আত্দগোপনে যান। সাড়ে তিন বছর আত্দগোপনে থাকার পর ১৯৬২ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন। ‘৬২ থেকে ‘৬৫- এই তিন বছর তিনি কারাবন্দী ছিলেন। ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে মহাবিতর্ক ও বিভক্তি দেখা দিয়েছিল তার ঢেউ এসে লাগে আমাদের দেশেও। ১৯৬৬ সালে পার্টি বিভক্ত হলে কমরেড আবদুল মতিন চীনপন্থি বলে পরিচিত অংশের সঙ্গে যুক্ত হন। ‘৬৮ থেকে ‘৭০ সালের মধ্যে ওই চীনপন্থি পার্টিও বহুধাবিভক্ত হয়েছিল। কমরেড আবদুল মতিনও একটি অংশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক কাজ করেন এবং অভ্যুত্থানের পরপরই ভাসানীর ডাকে যে ঐতিহাসিক লাল টুপি আন্দোলন শুরু হয়েছিল তিনি ছিলেন তার প্রধান সংগঠক। লাল টুপি আন্দোলন কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। একপর্যায়ে স্বল্পকালের জন্য নকশালবাড়ি আন্দোলনের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরে তিনি নকশাল রাজনীতির ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এবং তার দল পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসী যুদ্ধ করলেও একপর্যায়ে তারা বিশেষ পরিস্থিতির সুযোগে কৃষক বিপ্লব করার প্রয়াস গ্রহণ করেন। এই লাইন যে ভুল ছিল তা তিনি পরে অকপটে স্বীকার করেছেন।

মতিন ভাইয়ের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সততা নিঃসন্দেহে সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। পরে তিনি আরও বলেছেন, কমিউনিস্টরা জাতীয় প্রশ্নকে ভালোভাবে ধরতে পারেনি বলেই তাদের এ ব্যর্থতা। মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী রাজাকারদের হাতে তার বাবা আবদুল জলিল নিহত হন। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন তার এক ভাই গোলাম হোসেন মনু। স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশ সরকারের রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়েছিল আবদুল মতিন ও তার বাহিনীর। তার অপর এক ভাই সিরাজগঞ্জ কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার ঘুটুকে নির্মমভাবে হত্যা করে রক্ষীবাহিনী। মতিন ভাই নিজেও রক্ষীবাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছিলেন। আহত অবস্থায় তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৭২ থেকে ‘৭৭ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর তিনি কারাবন্দী ছিলেন। এটি তার চতুর্থবারের কারাজীবন। এরপরও ১৯৮৬ সালে এরশাদ সামরিক সরকারের আমলে কারাবন্দী হয়েছিলেন। এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভাঙাগড়ার ইতিহাসের মধ্য দিয়ে কমরেড আবদুল মতিনের জীবন অতিবাহিত হয়েছিল। একপর্যায়ে তিনি ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে ওয়ার্কার্স পার্টি ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সময় তিনি বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের উপদেষ্টা সদস্য ছিলেন।

মতিন ভাইয়ের সঙ্গে একত্রে কাজ করার সুযোগ ও সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আবার কখনো কখনো আমরা ভিন্ন অবস্থানেও ছিলাম। রাজনৈতিক মতপার্থক্য আমাদের মধ্যে অনেক সময় হয়েছে। কিন্তু মতপার্থক্য সত্ত্বেও এই মানুষটিকে কখনো আমি শ্রদ্ধা না করে পারিনি। মানুষটি ছিলেন আগাগোড়া বিপ্লবী। আগেই বলেছি, তার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সততা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। তিনি সারা জীবন খুব আর্থিক কষ্টের মধ্যে নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবনযাপন করে গেছেন। তা নিয়ে তার কখনোই আক্ষেপ ছিল না। স্ত্রী গুলবদননেসা মনিকা, যিনি তার রাজনৈতিক সহকর্মীও বটে, তারও সংসারের আর্থিক কষ্টের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ ছিল না। দুই মেয়ে মতিয়া বানু শুকু ও মালিহা শুভন একই আদর্শে বড় হয়ে উঠেছিল। সম্পদ-বিত্ত, পদ-পদবি, কোনোটার প্রতি তার কোনো মোহ ছিল না। অথচ ইচ্ছা করলেই, একটু আপস করলেই সব কিছু তিনি তার আয়ত্তের মধ্যে আনতে পারতেন। এবার ব্রেন স্ট্রোকে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে বর্তমান সরকার তার চিকিৎসার পুরো দায়িত্ব বহন করেছিল। ইতিপূর্বে আরেকবার তার হার্ট অপারেশন হয়েছিল। সে সময় পুরো খরচ সংগৃহীত হয়েছিল তার এলাকার দরিদ্র মানুষ এবং অন্য সুহৃদ ও ভক্তদের কাছ থেকে। ভাষা আন্দোলন যারা করেছেন তাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই গরিবানা হালে জীবনযাপন করেছেন। তার কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যাংক ব্যালান্স ছিল না। নিজস্ব বাড়ি ছিল না, গাড়ি ছিল না। তবে ছিল মহান আদর্শ। যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে তিনি যৌবনে গ্রহণ করেছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার প্রতি আস্থা ছিল দৃঢ় ও অবিচল। মৃত্যুর আগে এক লিখিত দলিলে আবদুল মতিন চক্ষু দান ও দেহদানের কথা উল্লেখ করেন। সেই অনুসারে মৃত্যুর পর তার চোখের কর্নিয়া চক্ষু ব্যাংক সন্ধানীকে দেওয়া হয় এবং মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার জন্য তার দেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজকে দেওয়া হয়। ৮ অক্টোবর ২০১৪ সালে ৮৮ বছর বয়সে বিপ্লবী আবদুল মতিনের জীবনাবসান হয়েছে। চলে গেলেন ইতিহাসের এক নায়ক। মহান বিপ্লবী আবদুল মতিন তোমাকে লাল সালাম। তুমি বেঁচে থাকবে কোটি কোটি মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের মাঝে।

লেখক : রাজনীতিক।