
জেসমিন প্রেমা:
করোনা মহামারীর এই সময়ে, আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষের জীবনযাত্রায় একটি আমূল পরিবর্তন হয়েছে।অনেক বিশ্লেষকই ইতিমধ্যে বলেছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোভিড-১৯ বিশ্বের কাছে সর্ববৃহৎ চ্যালেঞ্জ। এত বড় যুদ্ধ, এত কঠিন যুদ্ধ মানবজাতিকে একই সঙ্গে লড়তে হয়নি। এই যুদ্ধে প্রতিপক্ষ চোখের আড়ালে থেকে আক্রমণ করছে।’ সন্দেহ নেই, যথার্থ মন্তব্য।
করোনার অভিঘাতে সমগ্র বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্যে আজ বিপর্যস্ত। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ গোটা বিশ্বে যে বিষাদের ছায়া ফেলেছে, তাতে দুশ্চিন্তা, অবসাদ ও নানামুখী মানসিক চাপ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আত্মহত্যার মতো প্রবণতাও এ কারণে বাড়ছে।
পাশাপাশি অর্থনীতিতে যে প্রবল ধাক্কা লেগেছে বিশ্বব্যাপী, এ-ও বিশ্বের দেশে দেশে জীবনকে স্তব্ধ করে দিয়েছে বা দিচ্ছে। এরই প্রেক্ষাপটে তর্ক উঠেছে—জীবন আগে না জীবিকা আগে।
মনের ওপর প্রতিনিয়ত চাপ বাড়ছে। মানসিক স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে মানসিক শক্তি ধরে রাখতে কিংবা মনের স্বাস্থ্য সবল রাখতে নিচ্ছে নানান পদক্ষেপ।
করোনাকালে এমন মানসিক অবসাদ ও উদ্বেগ নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন, এমন ১৫ জন চিকিৎসক প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, করোনাকালে সাত ধরনের মানসিক রোগী তাঁদের কাছে বেশি আসছেন। সেগুলো হলঃ করোনায় সংক্রমিত হবেন—এ নিয়ে অতিরিক্ত উদ্বেগ; করোনা সংক্রমিত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার পর মানসিক অবসাদ; আবারও করোনা হতে পারেন, এ নিয়ে ভয়; করোনা সংক্রমিত হয়ে যাঁরা ভর্তি আছেন, তাঁদের অতিরিক্ত ভয়; শিশু–কিশোরদের দীর্ঘদিন সামাজিক দূরত্বে থাকার ফলে বিষন্নতা; চাকরি হারানো ও বেতন কমে যাওয়ার চাপ।
কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত তরুণ বা যুবকদেরও অনেকের শরীরে দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
স্কাসের মানসিক স্বাস্থ্য টিমের তথ্যমতে, করোনাকালে প্রায় ৮০ শতাংশ শিশু–তরুণ মানসিক চাপ ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে।
মানসিক চাপে আছেন বয়স্ক ব্যক্তিরাও। বেশির ভাগই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন।
সংক্রমণের শুরুর দিকে বলা হয়েছিল, বয়স্ক ব্যক্তিরা বেশি আক্রান্ত হবেন, তখন থেকেই তাঁদের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল। এরপর যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মানসিক চাপ বেশি দেখা যাচ্ছে। আর যাদের হয়নি, তাঁরাও সংক্রমণের ভয়ে থাকেন।
করোনাকালীন সময়ে মানসিক যে সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করছে সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূণ হলঃ আতঙ্ক, উদ্বিগ্নতার, হতাশা; সারাদিন মন খরাপ হওয়া; কারো সাথে মিশতে ইচ্ছে না হওয়া; খাবার খেতে না পারা বা প্রয়োজনের তুলনায় অধিক খাবার গ্রহন করা; ঘুমের সমস্যা হওয়া; নেতিবাচক চিন্তা করা; আত্নহত্যার চেষ্টা করা বা মৃত্যু চিন্তা আসা; শরীরে নানা রকম ব্যাথা বা অস্বস্থি অনুভব হওয়া; মনে রাখতে না পারা বা মনোযোগ দিতে না পারা; নিজেকে ছোট মনে করা ইত্যাদি।
করোনাকালে অবসাদ, উদ্বেগ ও তার ফলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
করোনার কারণে আমাদের চিন্তায়, আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, ও সমাজজীবনে একটা বিরুপ প্রভাব পড়ছে অর্থাৎ আমাদের কথায় ও কাজে একটা নেতিবাচক পরিবর্তন হতে শুরু করছে। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহনশীলতা কমে যাচ্ছে এবং যেটা মানুষের জীবনকে আরো কঠিন করে তুলছে।
করোনা উখিয়া তথা হোস্ট কমিউনিটির উপর কি প্রভাব ফেলেছে –
স্কাস মেন্টাল হেলথ টিম হোস্ট কমিউনিটিতে কাজ করতে গিয়ে সেখানকার মানুষের নানামুখী সমস্যা খুজে পেয়েছে।
যেমনঃ
অভাব আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত মধ্যবিত্ত সমাজ নিরবে কেঁদেছে। হত-দরিদ্ররা ত্রাণসহ বিভিন্ন সরকারি -বেসরকারি সহায়তা নিতে পারলেও মধ্যবিত্তরা আত্মসম্মানের কারণে সেটা পারেনি। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির কারণে উখিয়া টেকনাফে বসবাসরত মানুষেরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্ হচ্ছে।নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানু্ষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে এই এলাকার মানুষের মানসিক সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করছে। করোনার কারণে ফান্ড ক্রাইসিসের কারণে অনেক বেসরকারি চাকরিজীবীরা হঠাৎ চাকরি হারিয়ে ফেলছে। হঠাৎ, চাকরি হারিয়ে হোস্ট কমিউনিটির মানুষজন অর্থনৈতিকভাবে চরম সংকটে পড়ে গেছে। পরিবার- পরিজনের খরচ বহনের দায়িত্ব পালন করতে না পারার দুঃখ বুকে নিয়ে অনেকে জীবন্ত লাশের মত বেঁচে আছে। আবার অনেক সময় দেখা যাচ্ছে যে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রজেক্টগুলোকে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। অথচ এই এলাকার মানুষের জন্য এবং রোহিঙ্গা কমিউনিটির জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা তেমনই গুরুত্বপূর্ণ যেমন খাবার মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
করোনাকালীন সময়ে সঞ্চয়ে হাত পড়েছে নিন্মবিত্ত ও গরীব মানুষের। এটা তাদের মধ্যে অস্বস্থির জন্ম দিয়েছে। লকডাউনের সাথে গরীবের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী তাদের দিতে না পারার ব্যর্থতার কারণে সাধারণ মানুষদের মধ্যে সরকারি আদেশ বিশেষ করে লকডাউন না মানার প্রবণতা দেখা দিয়েছে যা জাতীয় জীবনে খারাপ প্রভাব ফেলবে। আবার, করোনাকালীন বেকারত্ব এবং কর্মহীনতা মানুষের মাঝে অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে , হতাশা জন্ম নিচ্ছে মানুষের মাঝে। করোনাকালীন সময়ে জীবিকার তাগিদে চাকরির খোঁজ করা এবং চাকরি করার ক্ষেত্রে নিজ যোগ্যতার দিকে তাকানোর সুযোগ হয়নি উখিয়া তথা হোস্ট কমিউনিটির শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর যা তাদের মনে হীনমন্যতার জন্ম দিয়েছে এবং এতে আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে বেঁচে থাকার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্ট এই মেন্টাল সেট আপ একটি সুদূরপ্রসারী কু- প্রভাব ফেলবে জাতীয় জীবনে যা একটি জাতিকে তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ভুলিয়ে দিয়ে শুধু খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাকে জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে বাধ্য করবে যেটা সভ্যতার এই যুগে কখনোই একজন সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষের কাম্য হতে পারেনা।
করোনাকালীন সময়ে আমাদের করণীয়ঃ
সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। যেমনঃ মাস্ক পরা, সামাজিক দুরুত্ব মেনে চলা ইত্যাদি।
ইতিবাচক চিন্তা করা। নেতিবাচক চিন্তা শরীর ও মনকে দূর্বল করে দেয়।
নিয়মিত দম চর্চা অর্থাৎ শ্বাসের ব্যায়াম করতে পারি।
যোগব্যায়াম বা শরীরচর্চা করতে পারি।
স্বাভাবিক জীবন যাপন করার চেষ্টা করা।
পরিবারের একে অপরকে সময় দেয়া।
সন্তানদের সাথে আরেকটু ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলা।
প্রত্যেক শিশুর পাশে একবার বসুন।
এটা আপনার সুবিধা মতো ২০ মিনিট বা আরো বেশি সময় হতে পারে। প্রতিদিনই একটা বিশেষ সময়। বেছে নিন। এতে করে ওই বিশেষ সময়টির প্রতি তাদের আগ্রহ সৃষ্টি হবে। তারা অপেক্ষা করে রইবে।
শিশুদের কাছে জানতে চান তারা কি চায়
তাদের মুখভঙ্গি আর শব্দ নকল করে মজা করা
গান করা, চামচ বাটি দিয়ে শব্দ করা
ব্লক বা বাটি দিয়ে কিছু বানানো
গল্প বলা, বই পড়া বা বই এর ছবি দেখা
টেলিভিশন আর ফোনের সুইচ বন্ধ রাখুন। এটা ভাইরাস ফ্রি সময়!
টিনএজার সন্তানের সাথে কি করা যায়? বালক বালিকার সাথে কি করা যায়
তারা পছন্দ করে এমন বিষয়ে কথা বলুন, যেমন- খেলা, মিউজিক, সেলিব্রেটি বা তাদের বন্ধু বান্ধব বিষয়ে।
সৃষ্টিকতার কাছে প্রার্থনা করুন। ধর্মীয় বই পড়ুন।
বাড়ির আশপাশে বা ছাদে, করিডোরে হাঁটতে বেরোন
বাড়ির আশপাশে এক সাথে হাঁটতে বেরোন
তাদের প্রিয় মিউজিক ছেড়ে একসাথে ব্যায়াম করতে পারেন
মিউজিক এর সাথে নাচুন অথবা গান করুন ২ একটা দল বানান, তারপর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করুন বা কিছু রান্না করুন।
তাদের কথা শুনুন, তাদের দিকে লক্ষ্য করুন। পুরো মনোযোগ দিন।
আনন্দে থাকুন!
পজিটিভ থাকা।
মনোবিজ্ঞানীরা এ সম্পর্কে ভেবে করোনাকালীন ও করোনা পরবতী মানসিক স্থিতিশীলতা তথা জীবনের হারানো সৌন্দর্য পুণরুদ্ধারে গবেষণায় মনোযোগ বাড়িয়ে এসময় আমাদের করণীয় কি সেটা বের করবেন।
মানুষ তার উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই জয়ী হয়েছে। ইতিহাস আমাদের দিকে। এ আধার কেটে যাক। জয় হোক জীবনের।
লেখকঃ চেয়ারপার্সন, সমাজকল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস)
পাঠকের মতামত