
অনলাইন ডেস্ক: ‘ধনকুবের’ অর্থ ধনদেবতা, কুবেরের মতো ধনশালী। ‘ধনকুবের’ শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বিলিয়ন বা ট্রিলিয়নের অঙ্কটাই আমাদের মাথায় প্রথম চলে আসে। বিভিন্ন জরিপের কল্যাণে বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি এবং তাদের সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে কমবেশি সবারই ধারণা রয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত সফলতা ছাড়িয়ে গোটা পরিবারের সাফল্য আমরা কম জানি! আজকে আমরা জানব বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনী পরিবারের কথা যাদের মাঝে অনেকেরই হয়তো বিলিয়নিয়ার বা ট্রিলিয়নিয়ার হতে খুব একটা বেগ পোহাতে হয়নি। শুধু উত্তরাধিকার সূত্রেই লাভ করেছেন অঢেল প্রভাব-প্রতিপত্তি। শীর্ষ ১০ পরিবারের হাতে যে পরিমাণ সম্পদ আছে তা ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির সম্মিলিত জিডিপির সমান। এ নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেনÑ শামস বিশ্বাস
ওয়ালটন পরিবার
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী পরিবার হিসেবে খ্যাত ওয়ালটন পরিবার রয়েছে বিশ্ব তালিকায় প্রথম স্থানে। এদের সম্পদের পরিমাণ ১৯০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ওয়ালটন মূলত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খুচরা দোকান পরিচালনা করে। সারাবিশ্বের ২৭টি ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রে ১১ হাজারেরও বেশি রয়েছে ওয়ালমার্টের শাখা। ওয়ালমার্ট বিশ্বের সর্ববৃহৎ খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া আয়ের দিক থেকেও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এটি সবচেয়ে বড়। স্যাম ওয়ালটন ১৯৬২ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ওয়ালমার্ট এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোম্পানির একটি। ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ তাদের রাজস্ব ছিল ৫১৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। ওয়ালমার্ট সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান প্রদানকারী পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। ওয়ালটন পরিবার এই সংস্থার প্রায় ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক। এতেই তাদের সম্পদের পরিমাণ হয়েছে পাহাড় সমান। স্যাম ওয়ালটনের সন্তান জিম এবং অ্যালিস ওয়ালটন দুজনেই আলাদাভাবে ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি মূল্যে সম্পদ নিয়ে ফোর্বসের শীর্ষ ধনীর তালিকায় রয়েছেন যথাক্রমে ১৬ এবং ১৭ নম্বরে।
কোচ ভ্রাতৃদ্বয়
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ভাই হলেন কোচ ভাইয়েরা। তারা এখন বিশ্বে তৃতীয় ধনী পরিবার। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রাইভেট কোম্পানির কোচ শিল্পগোষ্ঠীটির মালিক তারা। কোচ ভাইদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ১২৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। কোচ ভাইদের মধ্যে বড় চার্লস ডি গানাহ কোচ বা চার্লস কোচ ‘কোচ ইন্ডাস্ট্রি’র সহ-স্বত্বাধিকারী, বোর্ড চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। এমএসসি করেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে। পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবন শুরু করেন আন্তর্জাতিক ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট ফার্ম অরথুর ডি. লিটিলে। ১৯৬১ সালে তিনি ফিরে আসেন উইচিতায় এবং বাবার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান রক আইল্যান্ড ওয়েল অ্যান্ড রিফাইনিং কোম্পানিতে যোগদান করেন। কোচের ব্যবসায় দর্শন হলো বাজারভিত্তিক ব্যবস্থাপনা (এমবিএম)। যা তিনি ২০০৭ সালে বিশদভাবে তুলে ধরেন তার গ্রন্থ ‘সায়েন্স অব সাকসেস’-এ। ব্যবসার পাশাপাশি জনদরদি হিসেবেও চার্লসের ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। তাকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের একজন হিসেবে বিবেচিত করা হয়। ছোট ভাই ডিভিড হ্যামিলটন কোচ বা ডিভিড এইচ কোচ কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে। বড় ভাই চার্লস কোচের সঙ্গে তিনিও ‘কোচ ইন্ডাস্ট্রি’র সহ-স্বত্বাধিকারী।
আল সৌদ-সৌদি রাজপরিবার
সৌদি আরবের রাজপরিবার আল সৌদ পরিবারের সম্পদের
পরিমাণ প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক কোম্পানি সৌদি আরামকোসহ তেলশিল্পে এদের বিনিয়োগ আছে, সেখান থেকেই তারা এই সম্পদ তৈরি করেছে। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে সৌদি আরব শাসন করা এই রাজপরিবারের ১৫ হাজারেরও বেশি সদস্য রয়েছে। মুহাম্মদ বিন সৌদ ও তার ভাইদের বংশধরদের নিয়ে পরিবারটি গঠিত। বর্তমানে কিং সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ এই রাজবংশের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। তাদের আয়ের মূল উৎস হচ্ছে জ্বালানি তেলের খনি। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ইনসাইডার মাংকি জানায়, পুরো সৌদি আরব রাষ্ট্রটিই সৌদ পরিবারের আয়ের উৎস যেটিকে তারা পারিবারিক সম্পদ বলে মনে করে।
ডুমাস পরিবার
ডুমাস পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ৫৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। তাদের প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন হাউস হারমেস সিগনেচার স্কার্ফ, নেকলেটিস এবং পারফিউমের পাশাপাশি চমৎকার আইকনিক কেলি এবং বার্কিনের হ্যান্ডব্যাগগুলো দিয়ে বিশ্বজুড়ে ক্রেতাদের মন জয় করেছে। উনিশ শতকের শুরুতে থিয়েরি হার্মের হাত ধরে অভিজাত পোশাকের ব্যবসা শুরু করে এই পরিবার। আজ সংস্থাটি ব্র্যান্ড এন্ডোস করছেন বিশ্ববিখ্যাত বাস্কেটবল প্লেয়ার লেব্রন জেমস। অ্যাক্সেল ডুমাস এখন এই কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং পিয়েরে-অ্যালেক্সিস ডুমাস আর্টিস্টিক ডিরেক্টর।
ওয়েরথিমার পরিবার
ফ্রান্সের ফ্যাশন হাউস চ্যানেলের মালিক এই পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ৫৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। ‘চ্যানেল নাম্বার ৫’ নামের একটি বিখ্যাত সুগন্ধি ব্র্যান্ডও তাদের মালিকানাধীন। দুই ভাই অ্যালান ও গারহার্ড ওয়েরথিমার এখন এই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তাদের পিতামহ এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ফ্রান্সে বাস করা ১০ ধনী ব্যক্তির মধ্যে রয়েছেন অ্যালান ও গারহার্ড ওয়েরথিমার। তাদের সম্পদের বেশিরভাগ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত, এ ছাড়া ব্যবসা সম্প্রসারণ, চুক্তি, খুচরা বিক্রি, ওয়াইন এবং ঘোড়দৌড়ের মাধ্যমে তাদের অর্থ সম্পদ বেড়েছে।
ভ্যান ডেম, ডে স্পোয়েলবার্চ
ও ডে মেভিয়াস পরিবার
বুলগেরিয়ার এই তিন পরিবারের পানীয় তৈরির ইতিহাস ৫০০ বছরের। ১৯৮৭ সালে ভ্যান ডেম পরিবার ডে স্পোয়েলবার্চ ও ডে মেভিয়াস পরিবারের সঙ্গে যোগ দেয়। পানীয় ব্র্যান্ড ‘পাইদোউফ’ এবং ‘আর্টোইস’ একত্রিত হয়ে নতুন নামকরণ হয় ‘ইন্টারব্রু’। এই তিন পরিবারের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ৫৩ বিলিয়ন ডলার।
মার্স পরিবার
১২৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মার্স পরিবার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে। বিশ্বখ্যাত চকোলেট প্রস্তুত প্রতিষ্ঠান ‘মার্স ইনকরপোরেটেড’ হচ্ছে মার্স পরিবারের দখলে। কনফেকশনারি বেকারি দিয়ে এই পরিবারের ব্যবসা শুরু হয়, পরবর্তীকালে যা আরও অন্যান্য ব্যবসায় সম্প্রসারিত হয়। মার্স পরিবার না থাকলে হয়তো বিশ্বে মার্স বার, স্নিকারস, মিল্কি ওয়ে, এমএনএমের মতো চকোলেটই থাকত না। তাদের সম্পদের মূল উৎসই ক্যান্ডি ও চকোলেট। ঘরে পোষা প্রাণীর খাবারের বিখ্যাত ব্র্যান্ড পেডিগ্রিও মার্স পরিবারের মালিকানাধীন। ফ্র্যাঙ্ক মার্স ১৯১১ সালে সর্বপ্রথম ‘মার্স কোম্পানি’ থেকে চকোলেট উৎপাদন এবং বিপণন শুরু করেন। জ্যাকুলিন ও জন মার্সের পাশাপাশি ফরেস্ট জুনিয়রও এতদিন পারিবারিক ব্যবসার প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। তবে ২০১৬ সালে ফরেস্ট জুনিয়র মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে ফরেস্ট জুনিয়রের মেয়ে ভিক্টোরিয়া বোর্ড অব ডিরেক্টরের চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন। ব্যবসার শতভাগ শেয়ারই মার্স পরিবারের। ফ্র্যাঙ্ক মার্সের প্রতিষ্ঠিত এই ব্যবসার মালিকানা এখন তার তিন সন্তানের হাতে।
মুকেশ ও
অনিল আম্বানি
ভারতের বিখ্যাত আম্বানি পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ৫২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। টেক্সটাইলশিল্প দিয়ে এই পরিবারের ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু করেন ‘রিলায়েন্স গ্রুপ’র প্রতিষ্ঠাতা ধীরুভাই আম্বানি। একেবারেই শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন ধীরুভাই আম্বানি। স্বল্পশিক্ষিত এই ব্যক্তি সম্পূর্ণ নিজের বুদ্ধি দিয়েই গড়ে তোলেন সম্পদ।
ফোর্বস ম্যাগাজিনের এশিয়ার ধনী পরিবারের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে আম্বানিদের মালিকানাধীন বহুজাতিক রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ও আরও কিছু কোম্পানি। ধীরুভাই আম্বানির দুই ছেলে মুকেশ আম্বানির এবং অনিল আম্বানি ভারতের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি। তারা পেট্রোকেমিক্যাল, পেট্রোলিয়াম পরিশুদ্ধকরণ, টেলিকমিউনিকেশন, বিনোদন, সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা এবং তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ইত্যাদি ব্যবসায় নিজেদের সম্প্রসারিত করেছেন।
কারগিল ও ম্যাকমিলান
‘কারগিল ইনকরপোরেটেড’র অন্যতম কর্ণধার এই পরিবার। ১৮৬৫ সালে উইলিয়াম ওয়ালেস কারগিল এটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ১৫০ বছর ধরে ব্যবসা করছে কার্সিল এবং ম্যাকমিলান পরিবার। তাদের সম্পদের পরিমাণ ৪২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। ষষ্ঠ প্রজন্মের সদস্যরা বর্তমানে কার্গিল ইনকের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। আর এর ৯০ শতাংশের মালিক এই পরিবার। পরিবারের আয়ের প্রধান খাতই হচ্ছে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবসা। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিলিয়নিয়ার রয়েছে এই পরিবারে। মোট ১৪ জন বিলিয়নিয়ারের পরিবার কারগিল-ম্যাকমিলান পরিবার।
বোয়েহ্রিঞ্জার
পরিবার
১৩০ বছর আগে জার্মান ফার্মাসিউটিক্যালস সংস্থা ‘বোয়েহ্রিঞ্জার ইঙ্গলহেইম’ প্রতিষ্ঠা করেন বোয়েহ্রিঞ্জার পরিবার। কয়েক প্রজন্মের সাফল্যের সঙ্গে এই ব্যবসা পরিচালন করার কারণ আজ এই অস্থানে এসেছে বোয়েহ্রিঞ্জার ইঙ্গলহেইম। কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ বোয়েহ্রিঞ্জার পরিবারের হাতে হলেও বর্তমানে কোম্পানি পরিচালনা করেন ভন বাউমবাচ। এই দুই পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ৫২ বিলিয়ন ডলার।
পাঠকের মতামত