
সবকিছুই চূড়ান্ত, অপেক্ষা শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণার। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে আবারো দলীয় প্রার্থী করা হচ্ছে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মোহাম্মদ মনজুর আলমকে। দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সম্মতিতেই দলীয় হাইকমান্ড এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে। পাশাপাাশি রানিং মেয়র হিসেবে নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের সাধারণ নাগরিকের সাথে যোগাযোগ থাকা এবং চসিক কেন্দ্রিক বড় কোন দুর্নীতিতে মনজুর আলমের নাম না আসার বিষয়টিকেও প্রাধান্য দিয়েছে হাই কমান্ড।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দলের সর্বোচ্চ মহল থেকে গতকাল দুপুরে মনজুর আলমকে দলের প্রার্থী করার বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত প্রকাশ্যে প্রচারণা থেকে বিরত থাকারও নির্দেশ দেয় দলীয় হাইকমান্ড। এদিকে আগামী বুধবারের মধ্যে বিএনপি’র পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে উল্লেখ করে মনজুর আলমের ঘনিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বৃহস্পতিবার থেকে নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নামবেন তিনি। এর আগে বুধবার সকালে বর্তমান মেয়র হিসেবে চসিকের সর্বশেষ সাধারণ সভায় সভাপতিত্ব করবেন। প্রসঙ্গত, গত ১৮ মার্চ চট্টগ্রামসহ তিন সিটি কর্পোরেশেনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন কী না তা নিয়েই আলোচনা ছিল সর্বত্র। গতকাল রাত আটটায় এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত বিএনপি’র পক্ষ থেকে নির্বাচন করার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। তবে ইতোমধ্যে একাধিক সিনিয়র নেতা দলীয় চেয়ারপার্সনের সাথে দেখা করে বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছেন এমন ইঙ্গিত দেন।
সর্বশেষ গতকাল পিলখানা হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী ও বিএনপি নেতা নাসিরউদ্দিন পিন্টু আইনজীবীর মাধ্যমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের জন্য এবং চট্টগ্রামে মহিলা দলের ১৪ নেত্রীর কাউন্সিলর পদের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করায় বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। এমন পরিস্থতিতে চট্টগ্রামে কে হচ্ছেন বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী ? এ তা নিয়ে চলমান আলোচনা আরো বৃদ্ধি পায়।
ইতোপূর্বে আবদুল্লাহ আল নোমান ও আমীর খসরুকে দলের প্রার্থী করার খবর মিডিয়ার কল্যাণে জনসম্মুখে প্রকাশ পেলে দু’ জনই প্রার্থী হতে অনাগ্রহ দেখান। তবে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন মনজুর আলম এবং নগর বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন।
যে কারণে মনজুর আলমকে দলের সমর্থন ঃ
গত চসিক নির্বাচনে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুয়ায়ী নগরীর উন্নয়নে মেয়র মনজুর আলমের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তিন কারণেই আবারো দলের প্রার্থী করা হচ্ছে । কারণগুলো হচ্ছে নগর ভবনকে দলীয়করণ না করা, রানিং মেয়র হিসেবে নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের সাধারণ নাগরিকের সাথে যোগাযোগ থাকা এবং চসিক কেন্দ্রিক বড় কোন দুর্নীতিতে মনজুর আলমের নাম না আসা।
এছাড়া দলের ইচ্ছে থাকলেও আবদুল্লাহ আল নোমান এবং আমীর খসরুর স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে অনীহাও মনজুর আলমকে প্রার্থী করার বড় কারণ। তবে মনোনয়ন পেতে আগ্রহী হলেও ডা. শাহাদাত হোসেনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া রাজনৈতিক মামলায় তিনি জামিনে না থাকায় মনজুর আলমকেই বেছে নিয়েছে দলীয় হাই কমান্ড। দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, দায়ের হওয়া একাধিক মামলায় জামিনে না থাকায় ডা. শাহাদাত প্রকাশ্যে মাঠে আসতে পারবেন না।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার বিকেলে বেগম খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল চেয়ারপার্সনের পক্ষে আবদুল্লাহ নোমানের কাছে দলের প্রার্থী করার প্রস্তাব দেন। তখন আবদুল্লাহ আল নোমান অনাগ্রহ দেখান। এসময় নোমানের কাছে ডা. শাহাদাতের মামলার বিষয়টি উল্লেখ করে মনজুর আলমকে প্রার্থী করার ক্ষেত্রে সম্মতি রয়েছে কী না জানতে চাওয়া হয়। তখন আবদুল্লাহ আল নোমান ইতিবাচক মনোভাব দেখান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুল্লাহ আল নোমান দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘রানিং মেয়রের দায়িত্ব পালনের সুবাদে মৃদুভাষী ও সদালাপী মনজুর আলমের সাথে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ রয়েছে। উনার আলাদা একটি গ্রাউন্ডও তৈরি হয়েছে। এগুলোই মনজুর আলমের জন্য প্লাস পয়েন্ট। তাছাড়া প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে ওনার আগ্রহও ছিল। মেয়র হিসেবে মনজুর আলমের ব্যর্থতার কথাও বলেন অনেকে। এমন প্রশ্নের উত্তরে আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, উন্নয়নের চেষ্টা করেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে সফলও। হয়তো বিষয়গুলো প্রচারণায় আসেনি।
বিএনপি’র নির্বাচনের অংশ গ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেক নেতায় কারাগারে আছেন। মিথ্যে মামলাও হয়েছে হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। দলের চেয়ারপার্সনকে রাজনৈতিক কর্মসূচী করতে দেয়া হচ্ছে না। দলের যুগ্মমহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে উদ্ধারের বিষয়েও কোন তৎপরতা নেই। যদি বিএনপিকে রাজনৈতিক কর্মসূচী করতে না দেয় এবং নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি না হয় তাহলে নির্বাচনে যাওয়া অর্থবহ হবে না’।
এদিকে আমীর খসরুর ঘনিষ্ট সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে, কেন্দ্র থেকে আমীর খসরুর কাছেও জানতে চাওয়া হয় মনজুর আলমের বিষয়ে। তিনিও ডা. শাহাদাত হোসেনের মামলা সংক্রান্ত জটিলতা থাকায় মনজুর আলমের প্রতি সম্মতি রয়েছে বলে জানিয়ে দেন কেন্দ্রকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আমীর খসরু দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘কেন্দ্রের সাথে আলাপ-আলোচনা তো হচ্ছেই। তবে কেন্দ্র থেকে সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত প্রার্থীর নাম প্রকাশ করা ঠিক হবে না’। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পুরোনো প্রার্থীই বহাল থাকবেন নাকি চমক আসবে তা সময়ই বলবে’। নির্বাচনী পরিবেশ প্রসঙ্গে আমীর খসরু বলেন, ‘নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি না করলে তার দায়িত্ব নিতে হবে প্রশাসনকেই’।
এদিকে মনজুর আলমের ঘনিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, কেন্দ্রে নিজের প্রার্থীতার পক্ষে অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে মনজুর আলম গত চার বছরে নগরীতে ওয়ার্ডভিত্তিক ৯শ ১৩ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করার বিষয়টি তুলে ধরেন। এর বাইরে জাইকার মাধ্যমে প্রায় ৫শ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ শুরু হচ্ছে উল্লেখ করে মনজুর দাবি করেন, প্রতিশ্রুতিনুযায়ী উন্নয়ন কাজ করতে পারায় নগরবাসী তাকে মেয়র পদে দেখতে চাচ্ছেন। তবে দলের সমর্থন পেলেই তিনি নির্বাচন করবেন।
জানতে চাইলে মেয়র মনজুর আলম বলেন, ‘দল চাইলে নির্বাচন করবো’।
ডা. শাহাদাত বলেন, দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী এবং সাধারণ লোকজনও আমাকে মেয়র পদে দেখতে চাচ্ছেন। তবে দল সমর্থন দিলে নির্বাচন করবো। দল সমর্থন না দিলে নির্বাচন করবেন কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, দলের বিরুদ্ধে কোনদিন কিছু করিনি। ক্ষমতার জন্য রাজনীতি এমন তো না।
মনজুর আলমের প্রার্থীতা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ঃ
এদিকে মনজুর আলমকেই দলের প্রার্থী করা হচ্ছে এমন সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে গতকাল মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে। কেউ কেউ মনজুর আলমকে যোগ্য মনে করলেও অনেকে আবার বিরোধিতাও করেন। বিরোধিতাকারী মহলটির দাবি, গত পাঁচ বছর ধরে দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে বিরত ছিলেন মনজুর আলম। তবে দলটির একাধিক নেতাকর্মী বলেছেন, প্রকাশ্যে কর্মসূচিতে না এলেও দলীয় কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করেছিলেন তিনি।
নগর ছাত্রদলের সহ-সভাপতি জসীম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আন্দোলন সংগ্রামে মাঠে ছিল না এমন কাউকে দলের প্রার্থী করা উচিত হবে না। অতীতে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মনজুর আলমকে দেখা যায় নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডা. শাহাদাত হোসেনই এ ক্ষেত্রে দলের সমর্থন পেতে পারেন।
নগর ছাত্রদলের সভাপতি গাজী সিরাজ বলেন, আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিল এবং তৃণমূল কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে এমন প্রার্থীকেই দলীয় সমর্থন দেয়া উচিত। এর বাইরে কাউকে দিলে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করবে ছাত্রদল।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ১৭ জুন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছর ২১ জুন গেজেট প্রকাশিত হয় এবং ২২ জুলাই ক্ষমতাগ্রহণ করেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে মেয়র পদে থাকা নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ৯৫ হাজার ৫২৮ ভোটে পরাজিত করেন মনজুর আলম। ওই নির্বাচনে চসিকের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর আছেন ২১ জন এবং জামায়াত সমর্থিত কাউন্সিলর আছেন ২ জন।সূএ:অাজাদী
পাঠকের মতামত