
এম.কামাল উদ্দিন,রাঙামাটি:
বর্তমানে রাঙামাটিতে মাশরুম চাষ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনে দেখা দিয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা। মাশরুম চাষে আর্থিক সংকট দূর হয়ে তাদের প্রত্যেকের জীবনে অনেক চাষির এসেছে সাফল্য। পরিবারে এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা।
তারা জানান, নিজ নিজ বসতবাড়ি ও আশেপাশের আঙিনায় স্বল্প পূঁজিতে অতি সহজেই মাশরুম চাষ করা যায়। পরিশ্রমও একেবারেই কম। বর্তমানে রাঙামাটিসহ পাহাড়ে মাশরুমের চাহিদা অনেক। বরং চাহিদার তুলনায় মাশরুমের উৎপাদন কম। আর বীজের অভাবে ব্যাপকহারে মাশরুম চাষ করতে পারেন না চাষিরা। স্থানীয়ভাবে সরকারের কৃষি বিভাগের একটি মাশরুম উপকেন্দ্র থাকলেও সেখানে বীজ উৎপাদন হয় কম। অথচ মাশরুম চাষে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থনৈতিকভাবে আত্মকর্মসংস্থান ও আত্মনির্ভরশীলতার লক্ষ্য অর্জনে রাঙামাটিসহ পাশাপাশি পাহাড়ি এলাকাগুলোতে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রয়োজনীয় সহায়তা ও চাহিদা অনুযায়ী বীজ সহজলভ্য হলে মাশরুম চাষে পার্বত্য এলাকায় অর্থনৈতিকভাবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব বলে মনে করছেন গবেষক ও চাষিরা। এ কথা সরাসরি স্বীকার করেছেন সরকারের কৃষি বিভাগের রাঙামাটি মাশরুম কেন্দ্রের কর্মকর্তারাও।
সাম্প্রতিক সময়ে মাশরুম চাষে ব্যাপক সাফল্য দেখে কেবল অমূল্য ধন চাকমা, অমল কান্তি চাকমা, ননী জীবন চাকমা নয় কৃষি পদ্ধতির এ সবজী চাষে এগিয়ে এসেছেন রাঙামাটির অনেক বেকার ও কর্মহীন মানুষ। বর্তমানে এ পেশায় ঝুঁকছেন অসংখ্য চাষী। অমূল্য ধন চাকমা জানান, এক সময়ে বেকারত্বের অভিশাপে চরম অভাব-অনটনের মধ্যে ভূগতে হয়েছিল তাকে। ২০০৩ সালে মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এরপর মাত্র ২০-২৫ হাজার টাকায় শহরের বর্তমান ঠিকানায় শুরু করেন মাশরুম চাষ। শুরুতেই আসে সাফল্য। অর্জিত হয় স্বাবলম্বন। বর্তমানে মাশরুম চাষ করে মাসে অন্তত ১-২ লাখ টাকা গড় আয় আসে তার।
তিনি বলেন, বাজারে লোকজনের মাঝে প্রচুর চাহিদা থাকায় মাশরুম খুবই লাভজনক চাষ। একদম স্বল্প ব্যয় ও কম পরিশ্রমে মামশরুম চাষ করা যায়। সরকারি দরে মাশরুমের প্রতিটি বীজ স্পনের দাম আট টাকা। তবে সরকারিভাবে পর্যাপ্ত বীজের স্পন সরবরাহ না পাওয়ায় বাইরের থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হয় উচ্চদরে। এতে প্রতি বীজ স্পনের দাম পড়ে প্রায় বিশ টাকা। প্রতি স্পন থেকে মাশরুম উৎপাদন হয় ৫-৬ কেজি। স্পন সংগ্রহ করার পর ধানের খড় সিদ্ধ করে স্পনের বীজগুলো পলিটিনে প্যাকেজাত করে মেঝেতে অথবা মাচায় শুকনা জায়গায় রেখে প্রতিস্থাপন করতে হয়। এরপর ১০-১৫ দিনের মধ্যে ফলন আসতে শুরু করে। ওই সময় শুধু সকাল বিকাল পানি ছিটাতে হয় মাশরুমের প্যাকেটগুলোতে। কয়েক দিন পর ফলন পরিপক্ষ হলে মাশরুম তুলে বিক্রি করা যায়। বীজস্পনসহ প্রতিটি প্যাকেটে সব মিলিয়ে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৫০-৬০ টাকা। আর প্রতি কেজি মাশরুমের বর্তমান স্থানীয় বাজার দর ১৫০-২০০ টাকা। বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৩০-৪০ কেজি মাশরুম বাজারে বিক্রি করেন অমূল্য চাকমা। এতে মাসে তার গড় আয় প্রায় ১-২ লাখ টাকা বলে জানান তিনি।
অমূল্য ধন চাকমার সাফল্য দেখে এ চাষে ঝুঁকে পড়েন অমল কান্তি চাকমা, ননী জীবন চাকমাসহ প্রতিবেশী অনেকে। বর্তমানে তাদের সিএন্ডবি কলোনিতে ২০-২৫ চাষী মাশরুম চাষ করেন। রাতারাতি স্বাবলম্বী হয়েছেন সেসব মাশরুম চাষী সবাই।ভেদভেদী ৬ নং কৃষি
কলোনীতে মাশরুম চাষীদের উৎসাহিত করেছেন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুনুর
রশিদ ভ’ইয়া।
এছাড়াও গোটা রাঙামাটি শহর এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বহু চাষী জড়িত হয়েছেন মাশরুম চাষে। রাঙ্গামাটি শহরের তবলছড়িতে গড়ে উঠেছে একটি মাশরুম পল্লী। ওই পল্লীতে মাশরুম চাষ করেন ৩০ চাষী। মাশরুম চাষে সাফল্যের কথা জানিয়েছেন আরেক সফল চাষী সাগর মাশরুম সেন্টার নামের একটি মাশরুম খামরের মালিক সাগর দাশ। তিনি জানান, বর্তমানে মাসে লাখ লাখ টাকার মাশরুম বাজারজাত করেন তিনি।
রাঙামাটি মাশরুম উপকেন্দ্রের সহকারী মাশরুম কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন বলেন, রাঙামাটিতে মাশরুম চাষে ব্যাপক সফলতা আসায় এটি একটি জনপ্রিয় চাষাবাদ পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়ভাবে মাশরুমের চাহিদাও প্রচুর। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন আরও কম। সেজন্য মাশরুম চাষে এগিয়ে এসেছেন প্রচুর কর্মহীন মানুষ। এতে করে রাতারাতি স্বাবলম্বন অর্জনে সক্ষম হচ্ছেন তারা। উৎপাদনে বীজ সংকটের কথা স্বীকার করে এই মাশরুম কর্মকর্তা বলেন, চাহিদার তুলনায় আমরা চাষিদের মাঝে পর্যাপ্ত বীজ সরবরাহ দিতে পারি না। সরকারিভাবে বরাদ্দ কম পাওয়ায় আমরা ব্যাপকহারে মাশরুমের বীজ উৎপাদন করতে পারি না। অথচ রাঙামাটির এই মাশরুম উপকেন্দ্রের ল্যাবরেটরিতে বীজ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে দৈনিক পাঁচশ’ স্পনের। কিন্তু বরাদ্দের অপ্রতুলতার কারণে বর্তমানে উৎপাদন করা যাচ্ছে কেবল এক-দেড়শ’ বীজস্পন। বীজ উৎপাদনের জন্য বরাদ্দ পাওয়া যায় তিন মাস অন্তর মাত্র ৫০ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, বর্তমানে রাঙামাটিতে ব্যাপকহারে মাশরুমের চাষ বেড়েছে। এর কারণ লাভ অধিক। স্বল্প পূঁজি আর স্বল্প পরিশ্রম। চাহিদাও অনেক। আমরা চাষিদের মাঝে প্রশিক্ষণসহ প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে থাকি। আগ্রহী চাষিদের মাঝে বিনা সূদে ঋণ ব্যবস্থার জন্য প্রশিক্ষণ শেষে সনদ দেয়া হয়। চলতি বছর রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে বিনা সূদে ৫০ মাশরুম চাষিকে ঋণ দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণের সনদ প্রদর্শনে যে কোনো ব্যাংক থেকেও চাষিদের মাঝে ঋণ বিতরণের সুপারিশ করা হয়েছে। এ প্রর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার চাষিকে মাশরুম চাষে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে রাঙামাটিতে। এছাড়া ‘তবলছড়ি মাশরুম পল্লী’ নামে রাঙামাটি শহরে একটি মাশরুম উৎপাদন ক্ষেত্র গড়ে উঠেছে। সেখানে ৩০ চাষী মাশরুম চাষে নিয়োজিত। চলতি বছর এ পর্যন্ত রাঙামাটি মাশরুম উপকেন্দ্রে উৎপাদিত প্রায় ৫০ হাজারের অধিক মাশরুম বীজস্পন বিক্রি করে বর্তমানে প্রায় সোয়া চার লাখ টাকা রাজস্ব জমা রয়েছে। তিনি বলেন, অর্থনৈকিতভাবে সাফল্য অর্জনে রাঙামাটিতে মাশরুম চাষ ব্যাপক জনপ্রিয় ও বৈপ্লবিক সম্ভাবনা হয়ে উঠেছে।
গবেষকরা জানান, মাশরুম একটি সুস্বাদু ও সাধারণ শাকসবজির মতই খাবার। মাশরুমে বিভিন্ন রোগের প্রচুর প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। বিশেষ করে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, এইডসসহ মারাত্মক রোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ ক্ষমতা মাশরুমে আছে। বর্তমানে রাঙামাটিতে শীতাগে, ইমুজি, সিমাজি, পিএসসি, এইচকে-৫১, পিও-২, বাটন, মিল্কী, স্ট্র, ঋষি, পপ, গোল্ডেন ওয়েস্টার, পিসিওয়াইএসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাশরুম চাষ হচ্ছে।
পাঠকের মতামত