সেলিম উদ্দিন, ঈদগাঁও (কক্সবাজার) থেকে
কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও ও চকরিয়া উপজেলার খুটাখালীর গ্রামে গঞ্জে ফের একক বা সিন্ডিকেট গঠন করে মালয়েশিয়া সহ বিভিন্ন দেশে লাভ জনক কাজ বা চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে আদম পাচারকারী এক শ্রেণির ভূয়া দালালদের আনাগোনা বাড়ছে। কিন্তু যথা সময়ে বিদেশে যেতে না পারা, বিদেশে পৌঁছলেও প্রতিশ্র“ত কাজ না পাওয়ায় উভয়ের মধ্যে টাকার লেনদেন নিয়ে ঝগড়াঝাটি মারামারির ঘটনা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন কি অনেক ঘটনা থানা বা আদালতে পর্যন্তও গড়াচ্ছে। এছাড়া পাচারকারীরা বিদেশে পাঠানোর নামে এলাকার নিরীহ লোকজনকে ঠকিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি এক তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বৃহত্তর ঈদগাঁও’র জালালাবাদ, ঈদগাঁও, ইসলামাবাদ, ইসলামপুর, পোকখালী, চৌফলদন্ডী ও খুটাখালীর বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে অসংখ্য আদম পাচারকারী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। আবার অনেকে একক ভাবেও এ লাভজনক ব্যবসায় নেমেছে। তারা এলাকার সহজ সরল ও নিরীহ লোকজনকে মালয়েশিয়া, ভারতের মুম্বাই থেকে সৌদি আরব, ওমান, কাতার, দুবাই ও আবুধাবী সহ বিভিন্ন দেশে ভালো কাজ বা চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাজের কথা বলে প্রাথমিক ভাবে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ভাবে তাদের খপ্পরে পড়ে অনেকের বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেশেই থেকে যাচেছ। আবার অনেকের নির্ধারিত দেশের বদলে অন্য দেশে গিয়ে টাই হয়। যেখানে তাদের উপর চলে অমানুষিক নির্যাতন, জুটেনা এক বেলা খাবার থাকেনা আত্মীয় পরিজনের সাথে কোন যোগাযোগ। এছাড়া যাদের বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন পূরন হয় তাদের অবস্থা আরো করুণ। দালাল চক্র যে লাভজনক কাজ বা চাকুরী দেখিয়েছিল তার কোন হদিস নেই। বিমান থেকে নেমে দালাল চক্রের কারো দেখা মিলেনা। বিদেশ বিভূঁইয়ে চেনা কোন লোক নেই, জানেনা সে দেশের ভাষাও। ফলে এ পথ থেকে ও পথ আর এঘাট থেকে ওঘাট করতে করতে পড়ে যায় সেখানকার পুলিশের ফাঁদে। এর পর সোজা কারাগারে। আর যারা বাইরে থাকে তাদের জীবনটা আরো দূর্বিসহ। কোন কাজ না পাওয়ায় টাকাও মিলেনা। টাকার অভাবে খাবারও জুটেনা। এভাবে পেটের তাগিদে তাদেরকে সারাদিন মাটি ও বালি খুঁড়তে হয়। এ খবর যখন নিজের দেশে তাদের আত্মীয় পরিজনের কাছে পৌঁছায় তখন শুরু হয়ে যায় দালাল চক্রের সাথে ঝগড়াঝাটি ও মারামারির ঘটনা। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বিচার-নালিশ ও মামলা মোকদ্দমা যায় থানা আদালতে। কিছুদিন আগে জালালাবাদের বাহারছড়ার এক যুবক মালয়শিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে এলাকার নিরীহ লোকজনের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। আবার পার্শ্ববর্তী খুটাখালীর বার্মাইয়া হাছু হাতিয়ে নেয় অর্ধ কোটি টাকা। তারা যথা সময়ে বিভিন্ন লোকজনকে মালয়েশিয়া ও পাঠায়। তাদের বলা হয়েছিল ভাল কাজ দেবে সেখানে। কিন্তু তারা গিয়ে দেখে দালালের প্রতিশ্র“তি মিথ্যা। কোন কাজ নেই। দালালের কোন প্রতিনিধিও নেই সেখানে। ফলে কোন অবলম্বন নেই বিদেশে। পেটের দায়ে তারা সারাদিন বালি খুঁড়ার কাজ নেয়। এখবর দেশে এলে তাদের আত্মীয় স্বজনরা দালালের বাড়ীতে গিয়ে ধর্ণা দেয়। কিন্তু ততক্ষনে দালাল লাপাত্তা।
এদিকে ঈদগাঁও ইউনিয়নের মেহেরঘোনা, দরগাহপাড়া, ভাদিতলা, কানিয়ারছড়া ও ভোমরিয়াঘোনা থেকে বেশ কিছু লোক দালালের খপ্পরে পড়ে মাস দুয়েক আগে মালয়েশিয়া যায়। কিন্তু অদ্যাবধি তারা পরিবারের সাথে যোগাযোগ না করায় পরিবার পরিজন চরম উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে ইউনিয়নের চাঁন্দের ঘোনার ৬ যুবক স্থানীয় এক দালালের হাত ধরে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে বের হয়ে ৮ মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছে। তারা বেঁচে আছে কি মরে গেছে তাও বলতে পারছেন না আত্মীয় পরিজনেরা। ফলে তাদের পরিবারে চলছে প্রিয়জন হারানোর আহাজারী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় গিয়ে বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক বনে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে চাঁদেরঘোনা গ্রামের ৬ যুবক আমির হোসেনের পুত্র আবুল কালাম, মৃত মোক্তার আহমদের পুত্র মিজানুর রহমান, মৃত মোস্তফা কামালের পুত্র ছলিম উলল্লাহ, পাটুয়ারীর পুত্র মিজানুর রহমান, শাহ আলমের পুত্র নুরুল হুদা ও নুরুল আলমের পুত্র মিজানুর রহমানকে ৮ মাস পূর্বে মালয়েশিয়া পাঠানোর উদ্দেশ্যে টেকনাফ যায়। সেখানে দালাল হামিদের মাধ্যমে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রলারে তোলার জন্য টেকনাফ থেকে ইঞ্জিন চালিত বোটে উঠিয়ে দেয়। এর পর থেকে তাদের আর কোন খোঁজ খবর নেই। তারা কোথায় আছে, কি করছে, বেঁচে আছে কি মরে গেছে তাও জানেন না। এদিকে তাদের কোন হদিস না পেয়ে পিতা-মাতা, ভাই বোন ও স্ত্রী সন্তানদের মাঝে চলছে কান্নার রোল।
সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফের দালাল হামিদের রয়েছে ককসবাজার জেলাব্যাপী মাঠ পর্যায়ের দালাল চক্র। তারা এলাকা ভিত্তিক ভাগ হয়ে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে মালয়েশিয়া পাঠানোর নামে সহজ সরল প্রকৃতির দিন মজুর ও বেকার শ্রেণীর যুবকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এদিকে আইন শৃংখলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঈদগাঁও খুটাখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিশোর যুবকসহ রোহিঙ্গাদের মধ্যে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়া যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। বেশী আয় উপার্জন ও মালয়েশিয়া সরকার অভিবাসীদের বৈধ করে নিচ্ছে স্থানীয় দালাল চক্রের এমন লোভনীয় প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে বৃহত্তর ঈদগাঁও ও খুটাখালীর বিভিন্নœ এলাকার কিশোর-যুবকদের মধ্যে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবনতা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের মধ্যে আনেকে তাদের মা বাবাকে বলে কয়ে আবার অনেকে মা বাবার অগোচরে মালয়েশিয়া যেতে প্রথমিক ভাবে দালালের হাতে ২০ হাজার টাকা দিয়ে সমুদ্রের মাঝখানে অপেক্ষামান জাহাজে গিয়ে উঠে। এভাবে গত ১ বছর ঈদগাঁওর শিয়াপাড়া, দরগাহপাড়া, ভাদিতলা, মেহেরঘোনা, হাছিনাপাড়া, ইসলামাবাদের পশ্চিম গজালিয়া, পূর্ব গজালিয়া, করাচিপাড়া, হাজীপাড়া, আওলিয়াবাদ, ইসলামপুরের নাপিতখালী, ভিলেজার পাড়া, বামনকাটা, ধর্মেরছড়া, নতুন অফিস এলাকা, ভারুয়াখালী, চৌফলদন্ডী, পোকখালী ও জালালাবাদ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৮ শতাধিক কিশোর ও যুবক মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে সমুদ্র পথে যাত্রা করেছে। তাদের মধ্যে অনেকের থাইল্যান্ডের জঙ্গলে দালালের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অথবা গভীর সমুদ্রে দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে জীবনাবসান ও হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, টেকনাফের ৩ দালাল, ঈদগাঁও’র ২ দালাল ও খুটাখালীর ১ দালালের সহযোগিতায় সম্প্রতি এসব এলাকা থেকে অসংখ্য মানুষ মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছে। তবে তাদের অনেকেরই খবর নেই আত্মীয় পরিজনদের কাছে। ফলে চরম উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন তারা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ টেকনাফ উপজেলার মালয়েশিয়ার দালাল সিরাজ, শুক্কুর উখিয়া- টেকনাফ সহ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাবার পর সম্প্রতি ঈদগাঁও’র দিকে তাদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। তারা সমুদ্র পথে ঈদগাঁও থেকে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর জন্য সহযোগী হিসেবে নেয় মেহেরঘোনা ও খুটাখালীর ২ দালালকে। খুটাখালীর ঐ দালাল ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবকদের মালয়েশিয়া পাচারের জন্য গড়ে তুলেছে সংঘবদ্ধ চক্র। এদের হাতে সমূদ্রে এ পর্যন্ত কত মানুষের সলিল সমাধি হয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান নেই। অবৈধ পথে বিদেশে আদম পাচারের নতুন ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে গড়ে তুলে খুটাখালীকে। আগে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মাধ্যমে সমূদ্র পথে বেকার যুবকদের বিদেশ পাঠানোর প্রবণতা থাকলেও এখন তা পরিবর্তন হয়ে চকরিয়ার খুটাখালী জমজমাট আকার ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে কয়েক দফায় খুটাখালী থেকে ইঞ্জিন নৌকা যোগে আদম পাচারের চেষ্টার বহু ঘটনা ধরা পড়েছে। কিন্তু পাচারকারী চক্র দালালরা থেমে নেই। প্রশাসনের ধর পাকড়ের পরও খুটাখালীতে মালয়েশিয়া আদম পাচারকারী একটি সিন্ডিকেট ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গত ৬ মাস ধরে প্রতিদিন শত শত যুবক মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, খুটাখালীর ৪ জন আদম পাচারকারী দালাল ছদ্মবেশে এ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা হলেন ছৈয়দুল হক, আজম, ইছু মলই, ও বার্মাইয়া হাছু। স্থানীয় ইউপি মেম্বার আনোয়ার হোসেন জানান, নিরীহ যুবকদের কম টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়া নেয়ার কথা বলে লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে স্থানীয় দালালরা।
অন্য সুত্রে জানায়, গত ১ বছর ধরে বিভিন্ন পয়েন্টে মালয়েশিয়াগামী যুবকদের ট্রলার ডুবির ঘটনায় স্থানীয়দের মাঝে আতংক এখনো বিরাজ করছে। অনেকের ভাই, স্বামী, বাবা হারিয়ে এখন নির্ভাক দৃষ্টিতে থাকিয়ে আছে কবে শুনবে মালয়েশিয়াগামী তাদের আত্মীয়ের মৃত্যুর খবর।
সূত্র জানায়, মাত্র ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে দালালদের খ্প্পরে পড়ে সহজ সরল নিঃস্ব মানুষ গুলো পড়েছে চরম বেকায়দায়। অন্যদিকে প্রশাসনের তোড়জোড় লক্ষ্য করা গেলেও স্থানীয় গুটি কয়েক দালাল তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে বীরদর্পে। যার কারণে সাধারণ মানুষ মালয়েশিয়ার নামে অকালে সাগরে প্রাণ হারাচ্ছে।
প্রকাশিত: ০৯/০৪/২০১৪ ৬:২৪ অপরাহ্ণ
দেশের বহুল আলোচিত ককসবাজারের রামুর গর্জনিয়া বাজার পরিদর্শন করেছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ সালাহ ...
পাঠকের মতামত